এস এস ট্রাভেলস এর টিকেট |
আগেই বলে রাখি আমাদের যাত্রা ছিল দুই রাত, তিন দিনের। যাতে করে আমরা অনেক রিলাক্সে ঘুরে আসতে পারি। আপনারা ইচ্ছা করলে দুই রাত এক দিনের ঝটিকা সফরে বিরিশিরি ঘুরে আসতে পারেন।
যাত্রা শুরু করলাম আমরা চার জন বন্ধু... তারিখ ছিল নভেম্বর এর ১ তারিখ।
ভোরে মহাখালি থেকে সকালের নাস্তা করে নিলাম। তারপর সকাল ৭ টায় মহাখালি থেকে "এস এস ট্রাভেলস" এর "রনি" নামক বাসে চড়ে বসলাম। উদ্দেশ্য দুর্গাপুরের বিরিশিরির উৎরাইল বাজার, ঐ বাজারেই আমাদের আগের থেকে বুকিং দেওয়া স্বর্ণা গেস্ট হাউজ আছে, আর ঐখান থেকেই সব স্পট দেখার জন্য রিক্সা/মটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যায়।
আমাদের বাস গাজীপুর>ময়মনসিং>নেত্রকোনা হয়ে বিরিশিরি পৌছাল... সকাল ৭ টায় রওনা দিয়ে বাস বিরিশিরির উৎরাইল বাজারে পৌঁছেছিল দুপুর ২ টায়। টানা ৬ ঘণ্টা জার্নি। এমনিতে লং জার্নিতে আমার কোন সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা বাধাল রাস্তা। আমার জিবনে এরকম খারাপ রাস্তা আর দ্বিতীয়টি চোখে পড়ে নি। রাস্তা ছাড়া আর সবই সুন্দর ছিল... রাস্তার দুইপাশের ধানের ক্ষেত চোখ জুড়িয়ে দেয়...
বাস ছাড়াও আরও অনেক উপায়ে আপনি বিরিশিরি যেতে পারেন, এসব উপায় নিয়ে আমার আগের পোস্টে বিস্তারিত দেওয়া আছে। পোস্ট টি পড়তে পারেন "ঘুরে আসুন দুর্গাপুরের বিরিশিরি থেকে"।
তো দুপুরে বাস থেকে নেমেই গেস্ট হাউজে গেলাম, বাস একদম গেস্ট হাউজের সামনেই নামিয়ে দেয়। গেস্ট হাউজের নাম "স্বর্ণা গেস্ট হাউজ"। এই স্বর্ণা গেস্ট হাউজের কথা পরে বলছি।
বাস থেকে নেমেই আমাদের আগের থেকে বুকিং দেওয়া গেস্ট হাউজে উঠলাম। রুম ছিল ডাবল বেডের দুইটা রুম। ইচ্ছা করলে আপনারা একরুমেই ৪ জন থাকতে পারেন।যাই হোক তখন ক্ষুধায় সবার পেট চিঁ চিঁ করছে। রুমে ঢুঁকে গোসল সেরে ঐ গেস্ট হাউজেই দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। তারপর এলাকার আশেপাশের সাইট সিইং এর জন্য বের হলাম। গেস্ট হাউজ থেকে বের হলেই রাস্তার পাশে দাড়িয়ে থাকা রিক্সা আর অটো গুল মৌমাছির মত ছেঁকে ধরে। কিন্তু আজকের সাইট সিইং এর জন্য আমাদের এসবের একদমই দরকার নেই। পায়ে হেটেই দেখা সম্ভব।
এর মাঝে বলে রাখি, রিক্সা ওয়ালারা বলবে বিকালের ভেতরই গারো পাহাড় দেখিয়ে আনবে, আমি বলবো একদমই দরকার নেই। পরের দিন যখন রিক্সা/ বাইক ভাড়া করবেন তখন ওরাই আপনাকে গারো পাহাড় দেখিয়ে আনবে।
গেস্ট হাউজ থেকে সাইট সিইং এর জন্য বের হয়ে প্রথমে আপনার যেটা কাজ হবে সেটা হল পরের দিনের সমস্ত সাইট ঘুরে দেখানোর জন্য রিক্সা/ বাইক ঠিক করা। এটা আপনি নিজেও করতে পারেন অথবা গেস্ট হাউজের লোক জন দের কে ঠিক করে দিতে বলতে পারেন। তবে বেস্ট হবে নিজে ঘুরে ঘুরে দর-দাম করে ঠিক করা।
রিক্সা অথবা বাইকের ক্ষেত্রে আমি পরামর্শ দিব রিক্সা নিতে। কারন রিক্সায় করে ধিরে সুস্থে, অনেক মজা করে ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবেন। আর যদি আপনার কাছে সময় কম থাকে তবে বাইক/ অটো নিতে পারেন।
যাই হোক যেখানে ছিলাম, দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর বের হলাম। বের হয়েই পরের দিনের জন্য রিক্সা দর দাম করে ঠিক করে নিলাম। তারপর পায়ে হেটে শুরু করলাম লোকাল সাইট সিইং।
আজকের সাইট সিইং এ আমাদের লিস্টে আছে
- সোমেশ্বরী নদী
- ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী
- YMCA, YWCA এর মত গেস্ট হাউজ
প্রথমে গেলাম ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী তে। ঐখানে কিছুটা সময় কাটালাম, জানতে পারলাম দুর্গাপুরের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্পর্কে না জানা অনেক কিছু।
তারপর সেখান থেকে বের হয়ে পায়ে হেটে গেলাম সোমেশ্বরী নদীতে। তখন কিছুটা শীত শীত আমেজ ছিল। নদী শুকিয়ে যাচ্ছিল। শীত কালে যখন পানি কম থাকে তখন সোমেশ্বরী নদীতে হাটু পানিতে নেমে হাটা হাটি করবেন। ফিলিংস টা দুর্দান্ত হবে। এখান ওখান থেকে লোক জন কয়লা তুলছে।
নদী থেকে কয়লা তুলছে |
নদীর পাশে আছে কিছু মন্দির টাইপসের স্থাপনা, আর আছে একটা বধ্যভূমি। পড়ন্ত বিকেলে অসাধারণ মুহূর্ত। বলে প্রকাশ করার মত নয়। একেবারে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাটালাম নদীর তটে। দেখলাম সূর্যাস্ত।
পড়ন্ত বিকেলে সোমেশ্বর নদী |
ছবি দিয়ে কি আর বুঝানো যায়? নিজের চোখে না দেখলে বুঝতে পারবেন না।
সন্ধ্যা হয়ে গেল। সোমেশ্বরী নদী থেকে চলে আসলাম গেস্ট হাউজের সামনে। সেখান থকে পাশের ইটের রাস্তা ধরে কিছুদুর হেটে গেলেই পাবেন YMCA, YWCA গেস্ট হাউজ। রাত ৮-৯ টা পর্যন্ত সেখানে কাটালাম। অনেক ঠাণ্ডা লাগছিল তাই চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলাম। গেস্ট হাউজের প্রাঙ্গন টা অবর্ণনীয় সুন্দর। ফুলের বাগান, মাচাং বারান্দা, বসে জমপেশ আড্ডা দেওয়ার মত।
রাতে আমাদের স্বর্ণা গেস্ট হাউজে ফিরে এসে রাতের খাবার শেষ করে রুমে চলে গেলাম। প্রায় পুরো রাত টাই আড্ডা দিলাম সবাই মিলে।
পরদিন সকাল সকাল উঠে নাস্তা সেরে নিলাম গরম ভাত, বেগুন ভাজি আর মিক্সড সবজি দিয়ে। এখানকার মিক্সড সবজির কথা কি আর বলবো। সবার কাছে অনুরোধ থাকবে বিরিশিরি গিয়ে যেখানেই থাকুন না কেন স্বর্ণা গেস্ট হাউজের মিক্সড সবজি মিস করবেন না।
নাস্তা সেরে বেলা ১০ টার দিকে আগের থেকে ঠিক করা রিক্সায় চেপে বসলাম। এ ক্ষেত্রে বলে রাখি রিক্সা ঠিক করার সময় কোন কোন প্লেস গুলো ঘুরাবে, কতক্ষণ ঘুরাবে এসব সোজা সাপটা ভাষায় ঠিক করে নিবেন।
আমারা ঠিক করেছিলাম সারাদিন ঘুরাবে, আর যে যে প্লেস গুলা দেখাবে তা হলঃ
- চিনামাটির পাহাড়
- নীল/সবুজ পানির লেক
- গোলাপী পাহাড়
- মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তৈরি সুড়ঙ্গ
- রানিখং মিশন (সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী)
- ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত
- কমলা বাগান
- লোকনাথ মন্দির
- গারো পাহাড়
- আশ্রম
প্রথমে রিক্সায় উঠে চিনামাটির পাহাড়ের উদ্দেশে যাত্রা করলাম। পথে সোমেশ্বরী নদী পার হতে হয়। রিক্সা নৌকায় করে পার করা হয়। রিক্সা পার করার ভাড়া আমাদের কেই দিতে হয়। পার হয়ে দেখলাম এখান থেকে অটো পাওয়া যায় সব প্লেস ঘুরে দেখার জন্য। আপনারা রিক্সা ভাড়া না করেও নদী পার হয়ে অটো ভাড়া করতে পারেন। খরচ অনেক কমে যাবে।
সোজা টানা রাস্তা... দুইপাশে ধান ক্ষেত... এর মাঝ দিয়ে আমাদের রিক্সা রকেটের বেগে ছুটে চলেছে... ৩০ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম চিনামাটির পাহাড়ে। এখানেই আছে নীল/সবুজ পানির লেক, গোলাপী পাহাড়, মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তৈরি সুড়ঙ্গ।
নীল/সবুজ পানির লেক |
গোলাপী পাহাড় |
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তৈরি সুড়ঙ্গের পিলার |
এসব প্লেস দেখে তো আমার আক্কেল গুড়ুম। অনুরোধ করব নিজে গিয়ে দেখে আসুন। এর পর চড়ে বসলাম রিক্সায়। উদ্দেশ্য ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত ও কমলা বাগান।
চলতে থাকবে......
খরচঃ
মোটামুটি দুই রাত, তিন দিনের একটা খরচ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি, এই সময় নিয়ে গেলে ধিরে সুস্থে ঘুরে আসতে পারবেন। আপনি এক রাত দুই দিনেও ঝটিকা ট্যুর দিতে পারেন, এটা পুরটাই আপনার ব্যাপার, সে ক্ষেত্রে খরচ অনেক কমে যাবে।
আমরা গিয়েছিলাম ৪ জন...
বাসে যাওয়া আসাঃ (৩৫০+৩৫০)= ৭০০ টাকা
দুই রাত হোটেল ভাড়াঃ (৬০০+৬০০)=১২০০ টাকা, [পার হেড ৩০০ করে পড়ে দুই দিন থাকতে।]
রিকসা ভাড়াঃ ৯০০ টাকা পার রিক্সা (দামা দামি করে কম বেশি করে নিবেন) এক রিক্সায় দুই জন, সেক্ষেত্রে পার হেড ৪৫০ টাকা পড়ে।
৮ বেলা খাওয়াঃ (৮X ১৫০)=১২০০ টাকা পার হেড, আরও সস্তায় খেতে পারেন।
মোটঃ ২৬৫০ টাকা পার হেড।
তবে ইচ্ছা করলে দুই রাত, তিন দিনের একটা ট্যুর আপনারা ১৫০০-২০০০ টাকার ভেতর করে আসতে পারবেন।
========================================================================
মন্তব্য অথবা কোন প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করুন।
Post a Comment