ভ্রমণ, চিকিৎসা কিংবা ব্যবসার কাজে বিভিন্নভাবে আমরা অনেকে কলকাতা যাই। তবে সরাসরি নয়। দুটি ট্রেন খুলনা থেকে বেনাপোল হয়ে কলকাতা আসা-যাওয়া করছে। যারা নতুন তাদের কাছে এই যাত্রা কঠিন মনে হতে পারে। তবে এ বিষয়ে জানাশোনা থাকলে খুলনা থেকে কলকাতা যাওয়া সহজ হবে।
খুলনা থেকে বেনাপোলঃ
খুলনা থেকে বেনাপোল যাওয়ার জন্য খুলনা রেলস্টেশন থেকে দিনে দুটি ট্রেন চলাচল করে। ভোর ৬টায় এবং দুপুর ১২টায়। আপনি চাইলে নিজের সময় সুযোগ মতো যে কোনো একটি সময়ের ট্রেনে চড়ে বসতে পারেন। বাসেও বেনাপোল যাওয়া যায়, তবে সেটা সময় সাপেক্ষ আর কষ্টসাধ্য। বাসের থেকে ট্রেনে যাত্রা তুলনামূলকভাবে আরামদায়ক। সেই সঙ্গে ভাড়া কম। স্টেশনের টিকিট কাউন্টার থেকে বেনাপোলের টিকিট কেটে নিন। টিকিটের মূল্য ৪৫ টাকা। স্টেশন থেকে ট্রেন ঠিক সময়মতো ছেড়ে যায়। খুব একটা দেরি করে না। ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার পর বেনাপোল রেল স্টেশনে পৌঁছাতে প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগে।
বেনাপোল রেল স্টেশন থেকে বর্ডারঃ
বেনাপোল রেল স্টেশন থেকে বর্ডার কিছুটা দূরে। সেক্ষেত্রে বর্ডারে যেতে হলে অটো গাড়ির ওপর ভরসা করতে হবে। অটোতে করে বর্ডার পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। অনেকে ভাড়া বেশি চায়। সেজন্য আগে থেকে ভাড়া ঠিক করে অটোতে উঠতে হবে। বর্ডার যেতে ১৫ মিনিটের মতো সময় লাগে।
ইমিগ্রেশনঃ
বর্ডার এলাকায় নামার পর আপনাকে দালালরা আঁকড়ে ধরতে পারে। তাদের কথায় কান না দিয়ে সোজা ইমিগ্রেশন ভবনের ডানপাশে গিয়ে ভ্রমণ ট্যাক্স ৫০০ টাকা দিন। আগে এই ট্যাক্স ৩০০ টাকা ছিল। ভ্রমণট্যাক্স দিলে তারা আপনাকে একটি রশিদ দিবে। এই রশিদ খুব সাবধানে রাখুন। বাংলাদেশ অংশে আপনার কাছে কর্মকর্তারা ট্যাক্স রশিদ দেখতে চাইবে। তারপর ইমিগ্রেশনে সিল মারা শেষে নো ম্যানস ল্যান্ডে লাইনে দাঁড়িয়ে ভারতের ঢোকার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এখানে অনেক দালাল টাকার বিনিময়ে দ্রুত পার করে দেওয়ার কথা বললে এড়িয়ে যান। ভারতের ওপারের এলাকার নাম পেট্রাপোল। পেট্রাপোল ইমিগ্রেশনে ঢোকার সময় আপনাকে একটি স্লিপ দেওয়া হবে। সেটি নিজ হাতে পূরণ করুন। অনেকে এই স্লিপ ১০ টাকা দিয়ে দালালদের কাছ থেকে পূরণ করিয়ে নেয়। স্লিপ পূরণ করা আহামরি কিছু না। চেষ্টা করলে আপনি নিজেই পারবেন পূরণ করতে। এখানে বলে রাখা ভালো, অনেক দালাল আপনার পূরণকৃত স্লিপ দেখতে চেয়ে ভুল হয়েছে বলে ভয় ধরিয়ে দেবে। এত ভীত হবেন না। সচেতনভাবে নির্ভয়ে ইমিগ্রেশন করবেন।
টাকা ভাঙিয়ে রুপি করাঃ
ইমিগ্রেশন শেষে ভারতীয় অংশে ঢুকলে অনেক ব্রোকারেজ হাইজ দেখতে পাওয়া যাবে। অনেকে আপনাকে ডাকবে। আপনি তাদের ডাকে সাড়া না দিয়ে যাচাই করুন কোন ব্রোকারেজ হাউজ একশো টাকায় সর্বোচ্চ কত রুপি দিচ্ছে। তারপর বেশি যারা দিচ্ছে তাদের কাছ থেকে রুপি করে নিন। টাকা ভাঙানোর স্লিপ নিতে ভুলবেন না।
পেট্রাপোল থেকে কলকাতাঃ
পেট্রাপোল থেকে কলকাতা বাসে অথবা ট্রেনে যেতে পারেন। তবে কলকাতায় বাসের থেকে ট্রেন ভ্রমণ আরামদায়ক। ট্রেনে করে কলকাতা শিয়ালদহ স্টেশনে যাওয়ার জন্য পেট্রাপোল থেকে অটোতে করে বনগাঁও রেল স্টেশনে যেতে হবে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ রুপি। বনগাঁও স্টেশনে যেতে সময় লাগবে ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। স্টেশনে প্রতি ঘণ্টায় কলকাতা যাওয়ার ট্রেন পাওয়া যায়। স্টেশনে ঢুকতে নিরাপত্তা দানে নিয়োজিত পুলিশ আপনার কাছে পাসপোর্ট দেখতে চাইবে। তারপর কাউন্টার থেকে শিয়ালদহর টিকিট কেটে নিন। টিকেটর মূল্য ২০ রুপি জনপ্রতি। শিয়ালদহ স্টেশন পৌঁছে স্টেশন এলাকা না ছাড়া পর্যন্ত টিকিট সাবধানে রাখবেন। স্টেশনে নেমে টিকিট চেকার টিকিট দেখতে চাইলে দেখাতে না পারলে জরিমানা করে দেবে। কোনোভাবে মাফ পাওয়া যাবে না। দুই ঘণ্টার কিছুটা বেশি সময় লাগবে শিয়ালদহ পৌঁছাতে। বাসে করে গেলে পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে। সময় আর অর্থ বাঁচাতে চাইলে ট্রেনে ভ্রমণ করা উচিত হবে।
থাকা খাওয়াঃ
শিয়ালদহ নেমে স্টেশনের বাইরে বাজারের পাশে একটু ভেতরে বেশ কিছু হোটেল আছে যারা পর্যটকদের ভাড়া দেয়। এই এলাকায় হোটেল ভাড়া খুব কম। এসি ঘর ৭০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে পেয়ে যাবেন। আর নন এসি ৪০০-৫০০ টাকা। সেজন্য আপনাকে দরদাম করতে হবে। চাইলে নিউমার্কেট এলাকার হোটেলগুলোতে থাকতে পারেন। শিয়ালদহ থেকে পাঁচ টাকা বাস ভাড়া। ট্যাক্সিতে গেলে ৮০-১০০ টাকা ভাড়া নিবে। নিউমার্কেট এলাকায় অনেক হোটেল আছে। এখানের হোটেলগুলোর ভাড়া কিছুটা বেশি।
খাওয়ার জন্য বেশকিছু হোটেল আছে শিয়ালদহ আর নিউমার্কেট এলাকায়। যারা রক্ষণশীল মুসলিম। গরুর মাংস খেতে চান তাদের জন্য শিয়ালদহতে কয়েকটি মুসলিম হোটেল আছে। টিপু সুলতান মসজিদের পাশে অনেক মুসলিম হোটেল আছে। খুব কম দামে এখানে গরুর মাংস খেতে পারবেন।
ঘোরাফেরাঃ
ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল পার্ক যেতে পারেন। ভিতরে প্রবেশের টিকিটের মূল্য ২০ টাকা। পার্কের ভেতরের প্রাসাদের ভেতর প্রবেশ করার পর আপনি ইতিহাসের ভিতর হারিয়ে যাবেন। ইতিহাসের এমন সব নিদর্শন দেখতে পাবেন যা আপনার মোহময় করে রাখবে কিছু সময়। এরপর পাশে নন্দনে যেতে পারেন। নন্দনকে ঘিরে কলকাতায় সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। চাইলে এখানে কলকাতার আর্ট ছবি দেখে নিতে পারেন। এ ছাড়া ময়দান থেকে ঘুরে আসতে পারেন। সবই কাছে। তবে মান্না দের সেই কালজয়ী গানের কফি হাউজে অবশ্যই ঘুরে আসবেন। কলেজ স্ট্রিটে অবস্থিত কফি হাউজটি শিয়ালদহ থেকে বেশি সময়ের পথ নয়। শিয়ালদহ নিউমার্কেট এলাকার ভবন দেখলে মনে হবে সেই পুরোনো কলকাতা। তবে যদি নিউটাউনে যান তাহলে নতুন এক কলকাতাকে দেখতে পাবেন। এ ছাড়া সায়েন্স সিটি , রবীন্দ্রসদন , হাওড়া ব্রিজ , শহীদ মিনার , নজরুল মঞ্চ,টালিগঞ্জে উত্তম কুমার ফিল্ম সিটি ঘুরে আসতে পারেন। মেট্রো ভ্রমেণের অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। নিউ মার্কেট,রবীন্দ্র সদন,এস প্লানেড সহ বেশ কয়েক জায়গায় মেট্রো স্টেশন আছে। তবে রাত আটটার পর কলকাতায় মেট্রো চলে না।
কেনাকাটাঃ
কলকাতায় যাবেন আর কেনাকাটা করবেন না তা কি হয়? নিউমার্কেট এলাকায় সব থেকে বেশি বাংলাদেশি কেনাকাটা করে থাকে। এখানে জিনিসপত্রের দাম সস্তা। বাংলাদেশি দেখে আপনার কাছ থেকে দাম বেশি চাইতে পারে। আপনি দরদাম করে জিনিস কিনবেন। ৫০০ টাকার জিনিস দুই হাজার টাকা চাইতে পারে। বড় বিপণিবিতানগুলোতে জিনিসপত্রের এক দাম। পছন্দ হলে কিনে নিয়ে চলে আসতে পারবেন। যারা আরো সস্তা দামের জিনিসপত্র কিনতে চান তারা গড়িয়া হাট যেতে পারেন। কম দামে ভালো জিনিস পাবেন।
এক নজরে খরচঃ
- খুলনা রেল স্টেশন থেকে বেনাপোল রেল স্টেশন ভাড়া ৪৫ টাকা।
- বেনাপোল রেলস্টেশন থেকে বর্ডার অটো গাড়িতে ভাড়া ১০ টাকা।
- ভ্রমণ ট্যাক্স ৫০০ টাকা।
- পেট্টাপোল থেকে বনগাঁও স্টেশন অটোতে ভাড়া ৩০ রুপি (৩৯ টাকা)।
- বনগাঁও স্টেশন থেকে কলকাতা শিয়ালদহ স্টেশন ২০ রুপি (২৬ টাকা)।
সর্বোমোট ৬২০ টাকা।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ
টাকার মান কমবেশি হতে পারে।
যা মনে রাখবেনঃ
১. কোনো দালালের হাতে পাসপোর্ট তুলে দেবেন না।
২. পাসপোর্টের প্রথম কয়েক পাতার ফটোকপি সাথে রাখবেন।
৩. নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া কাউকে নিজের তথ্য দিবেন না।
৪. যেসব এলাকায় ছবি তোলা বারন সেখানে ছবি তুলতে যাবেন না। ছবি তুলতে গেলে পুলিশি হয়রানিতে পড়তে পারেন।
========================================================================
মন্তব্য অথবা কোন প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করুন।
Post a Comment