মহামায়া লেক এ নাইট ক্যাম্পিং ও কায়াকিং

মহামায়া
মহামায়া
ভ্রমন আমার নেশা। অল্প খরচে ভ্রমন প্ল্যান সবার সাথে সেয়ার করতে Tour on budget ব্লগ টিতে লেখালেখি করি। এবারের Cheap places to travel এ থাকছে "মহামায়া লেক এ ক্যাম্পিং ও কায়াক" নিয়ে তথ্য।  তো চলুন শুরু করা যাক, গল্পের শেষে ভ্রমন খরচ দেওয়া আছে।

অনেক দিন পর একটানা দুইদিনের একটা ছুটি পেয়েছি। ২১ শে ও ২২ শে ফেব্রুয়ারী... প্রথমে প্ল্যান করা হল নিঝুম দ্বিপ যাবো, কিন্তু সময় সল্পতার কারনে পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল মিরসরাই এর মহামায়া লেক এ যাবো। প্রধান আকর্ষণ হবে লেকের পাড়ে রাতে তাঁবুতে ক্যাম্পিং এবং লেকে কায়াক করা। 

চট্রগ্রাম শহর থেকে ৪৫ কিঃ মিঃ দুরে ঢাকা চট্রগ্রাম মহাসড়কের পাশে মিরসরাই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ কৃত্রিম লেকটি। লেকটি কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হয়েছে ইকোপার্ক। আছে রাবার ড্যাম। পাহাড়ের কোলঘেঁষে আঁকাবাঁকা লেকটি দেখতে অপরূপ সুন্দর।

স্থানীয় দের ভাষ্য অনুযায়ী লেক টা তৈরি করা হয়েছিল পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে, কিন্তু পরে দেখা গেল যে এখান থেকে যতটুকু বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে সেটা দিয়ে বড়োজোর শুধু মিরসরাই উপজেলার চাহিদা মিটতে পারে, মানে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। তাই পরবর্তীতে প্রকল্পটি বাদ দেওয়া হয়, এবং লেকের পানি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়।

তো ফিরে আসি আমাদের মূল গল্পে।

ট্যুর এর ১ সপ্তাহ আগে ফোন দিলাম Mahamaya Kayaking Point-MKP কে তারা ঐখানের তাবু ও কায়াক এর ব্যবস্থা করে দেয়।

যোগাযোগের নাম্বারঃ 

শামীম- ০১৮১৬১১০৩০০ 
সাইদুল- ০১৬১৯৩৯৯৯১৫ 
রানা- ০১৬১৬৭৯৬৯৬৯

আমরা ছিলাম ৮ জন, তাই সব থেকে বড় তাঁবুটা বুকিং দিলাম, এর পর শুরু হল অপেক্ষার পালা। অপেক্ষার পালা যেন শেষ হয় না। আসলে কোন কিছুর জন্য অপেক্ষার সময় টা অনেক দীর্ঘ হয়, কিন্তু যেটার জন্য অপেক্ষা করা সেটা চলে আসলেই চোখের পলকে শেষ হয়ে যায়। অনেক কষ্টে শেষ হল অপেক্ষা। ২০ তারিখ অফিস শেষ করে বের হলাম সন্ধ্যা ৬ টায়। বের হয়ে পড়লাম মহা বিপাকে। কারন? ঐ যে ঢাকার চির-পরিচিত ট্র্যাফিক জ্যাম। কারওয়ান বাজার থেকে মোহাম্মাদপুর পর্যন্ত যেতে সময় লাগলো পাক্কা আড়াই ঘণ্টা। আমাদের এক বন্ধুর ভাষায় "কুত্তা মারা জ্যাম।" ঘড়িতে তখন সময় ৮ঃ৪৫। আমাদের প্ল্যান ছিল সায়েদাবাদ থেকে লোকাল বাস এ করে মহামায়া যাবো। রাতের শেষ বাস ১২ টায়। একটু পর আবার একুশে ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহর। সেইভাবে প্রস্তুতি নিয়ে ৯ঃ৩০ এ বের হলাম বাসা থেকে। ফোন দিলাম বন্ধুদের, তারা প্রত্যেকেই জ্যাম এ বসে আছে রাস্তায়। মোহাম্মাদপুর এ থাকি আমরা ৪ জন। এই ৪ জন একত্রিত হয়ে একটা সিএনজি নিলাম। ভাড়া চাইল ৫০০ টাকা। কি আর করার, দিলাম রওনা। সাইন্স ল্যাব পর্যন্ত আসতে লাগলো দেড় ঘণ্টা, তারপর তো আক্কেল গুড়ুম, পুরা রাস্তা ফাঁকা। আমাদের সিএনজি একটানে পৌঁছে গেল সায়েদাবাদ। আমরা ৪ জন নেমে বাস ঠিক করতে চললাম, বাকি ৪ জন এখনও জ্যাম এ। মনে হয় না ১২ টার আগে আসতে পারবে।

বাসের টিকেট কাটতে গিয়ে গলায় ফাঁস পড়ার মত অবস্থা। স্ট্যান্ড এ বাসের অভাব নেই, কিন্তু সবাই একজোট হয়ে সিন্ডিকেট করে ভাড়া চায় ৮০০ টাকা। এক পয়াস ও কেউ কম নিবে না। যেখানে নরমাল ভাড়া ৩৫০ টাকা। আমরা নামবো মিরসরাই এর ঠাকুরদীঘি বাজার। এত ভাড়া দিয়ে তো আর যাওয়া সম্ভব না। তবে আমরাও বদ্ধ পরিকর, বাসা থেকে বের যখন হয়েছি কোথাও না কোথাও যাবোই। 

অনেক চিন্তা করে ঠিক করা হল প্ল্যান বি। যেহেতু তাঁবুতে অ্যাডভান্স করা হয়ে গেছে তাই মহামায়া লেক মিস করা যাবে না। ঠিক হল এখান থেকে চাঁদপুর যাবো, তারপর সেখান থেকে ট্রেন এ করে মিরসরাই। চাঁদপুর থেকে ভোর ৫ টায় ট্রেন। সায়েদাবাদ থেকে গেলাম সদরঘাট। বন্ধুদের ভেতর জ্যাম এ যারা আটকে ছিল তাদের বলে দেওয়া হল সদরঘাট চলে যেতে। সদরঘাট থেকে চাঁদপুর এর শেষ লঞ্চ রাত ১২ঃ৩০ এ। লঞ্চ এ করে চাঁদপুর যেতে লাগবে ৪ ঘণ্টা, সেই হিসেবে সকালের ট্রেন ধরতে পারব আমরা। যথা সময়ে লঞ্চ ছাড়ল, এরই মদ্ধে সবাই পৌঁছে গেছে সদরঘাট এ। সবাই মিলে লঞ্চ এ উঠলাম।

লঞ্চ এ মহামারি অবস্থা। সরকারি ছুটি পড়েছে ৩ দিনের, ঢাকা ফাঁকা করে সব যে যার বাড়ি যাচ্ছে। এর ফলে লঞ্চ এ বিন্দু মাত্র জায়গা নেই। ঠিক হল লঞ্চ এর ছাদে করে যাবো সবাই। ছাদেও জায়গা নাই। লঞ্চ এর ডেক থেকে ছাদে উঠতে সময় লাগলো ৪৫ মিনিট, বুঝতেই পারছেন পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি। কোনরকমে ছাদে উঠে কাপড় বিছিয়ে বসে গেলাম ৮ জন। অন্যরকম এক পরিবেশ। শত শত মানুষ একসাথে ছাদে বসে আছে, কেউ দল বেধে গান করে, কেউ বা কার্ড খেলে। এরই মাঝে চলছে পুরাদমে গঞ্জিকা সেবন!! ছেলে, বুড়ো,মেয়ে সবাই মিলে মিশে একাকার। ছবিতে দেখতেই পারছেন কি ব্যস্ত পরিবেশ। আমরাও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলাম তাদের সাথে। মারামারি-বকাবকি-গালাগালি কি নেই সেখানে। ছাদের ভাড়া পার হেড ৭০ টাকা করে নিল।

লঞ্চের ছাদ
লঞ্চের ছাদ
এরভেতর এক ফ্রেন্ড ফেসবুক থেকে খবর পেল ঢাকার চকবাজারে আগুন লেগেছে, দমকলের ৩২ টা ইউনিট একসাথে কাজ করছে আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে।

ট্যুর শেষে পরবর্তীতে জানতে পারি হতাহতের সংখ্যা প্রায় ৬৭, আল্লাহ এই নিহতদের জান্নাত নসিব করুন।

লঞ্চের ছাদে ঠাণ্ডা পরিবেশ, চারপাশে কুয়াশা, ভালই লাগলো। আড্ডা-ঝিমঝিমানি সবই চলছে একসাথে। সবাই যেহেতু সারাদিন অফিস করে এসেছে তাই একটু ক্লান্ত। এভাবে রাত ৩ টা বাজল, শুরু হল প্রচণ্ড কুয়াশা। এত গাঢ়ো কুয়াশা যে মোবাইলের ফ্লাশ লাইট জ্বেলে নিজের হাত পর্যন্ত দেখতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড কুয়াশা তে গায়ের জামা, কাপড় ভিজে চপচপ করছে। এই কুয়াশা তে লঞ্চ সামনে আগাতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে হল লেট, এবং ট্রেন মিস। কপাল টাই খারাপ। ট্যুর এর শুরু থেকে কুফা লেগে আছে।

অনেক কষ্ট করে রাত টা পার করার পর লঞ্চ চাঁদপুর এ ভিড়ল সকাল ৮ টায়। ওহ একটা কথা বলে রাখি, তাঁবু কিন্তু সন্ধ্যা ৬ টা থেকে পরদিন সকাল ১০ টা পর্যন্ত ভাড়া হবে। এর কারন জানতে চাইলে Mahamaya Kayaking Point-MKP জানালো সারাদিন অনেক দর্শনার্থী আসে লেক দেখতে ও কায়াক করতে, তারা চলে যায় সন্ধ্যা ৬ টায়, তাই সন্ধ্যার আগে তাঁবু ফেললে অতিউৎসুক জনতা খুব জ্বালাতন করে, এই জন্য তাঁবু ফেলা হয় সন্ধ্যা ৬ টার পর এবং সকাল ১০ টায় আবার তাঁবু তুলে ফেলা হয়।

যেহেতু প্ল্যান অনুযায়ী আমরা মিরসরাই পৌঁছে যাবো সকাল ১০ টায় আমাদের ইচ্ছা ছিল সন্ধ্যা ৬ টার আগে মিরসরাই এর অন্যান্য কিছু স্পট দেখে আসব।

এখন তো কিচ্ছুই করার নাই, কারন কুয়াশার জন্য লঞ্চ লেটের ফলে ট্রেন মিস, তো মিরসরাই এর আশেপাশের স্পট দর্শন প্ল্যান বাদ। প্রথম থেকে যেভাবে কুফা লেগেই আছে সন্দেহ হয় মহামায়া তে পৌছাতে পারি কিনা, এখন মনে প্রাণে শুধু একটাই ইচ্ছা মহামায়া লেক পৌঁছানো। ঐযে কথায় আছে না, মালিক ভিক্ষা দরকার নাই দয়া করে তোর কুত্তা ঠ্যাকা।

লঞ্চ থেকে ঘাঁটে নামলাম ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮ টায়। নেমে সিদ্ধান্ত নিলাম বাসে করে মিরসরাই যাবো। ঘাঁট থেকে বাসস্ট্যান্ড এ যাবার জন্য সিএনজি ঠিক করতে গিয়ে আক্কেল গুড়ুম। ভাড়া চায় পার হেড ৫০ টাকা করে। ভাবলাম এত দূর বাস স্ট্যান্ড, কিন্তু তখনও জানতাম না বাস স্ট্যান্ড মাত্র ২০ টাকা ভাড়া। আসে পাশে ৩-৪ টা দরদাম করে দেখলাম যে সবাই ৫০ টাকা ভাড়া চায়, অগত্যা কি আর করার, উঠলাম সিএনজি তে। বাস স্ট্যান্ড এ নামার পর আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে এক ভাগ গেলাম টিকেট কাটতে, আর এক দল খাবার হোটেল খুঁজতে, যথারীতি বাস কাউন্টার থেকে টিকেট কাটলাম মিরসরাই এর। ভাড়া ৩৫০ টাকা।

এর পর গেলাম হোটেল এ, আমাদের সাথে সাথে ১৫ জনের আরেক দল এসে হোটেল এ ঢুকল, একসাথে খেতে বসলাম, মনে আগের থেকেই খুঁত খুঁত করছিল এত কম দূরত্ব সিএনজি তে তো এত ভাড়া হবার কথা না। ১৫ জনের দলে একজন চাঁদপুরের স্থানীয় ছিল, কথায় কথায় বের হল ঘাঁট থেকে  বাস স্ট্যান্ড এর ভাড়া ২০ টাকা। তারমানে আবার আমরা ধরা খেয়েছি, পুরা মফিজ কট।

কপালে আরও কি আছে কে জানে !!

আমাদের বাস ১০ টায়, সেই মোতাবেক খাওয়াদাওয়া করে চলে আসলাম বাস স্ট্যান্ড এ। কিন্তু বিধি বাম, বাস রাস্তায় এক্সিডেন্ট করেছে, লেট হবে। এবার তো এক বন্ধু বলেই ফেললো, যে লঞ্চ এ আসছি ঐ লঞ্চ এই ঢাকায় ফিরে চল, আর ট্যুর এর দরকার নেই।  পরে শুরু হল মোটিভেশন, কষ্ট তো একটু হবেই, কারন আমরা যাচ্ছি বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম লেক মহামায়া লেকে কায়াকিং এবং লেকের পাড়ে তাবুতে রাত্রিযাপন করতে।

চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড
চাঁদপুর বাসস্ট্যান্ড
আবার শুরু অপেক্ষার পালা, কখন বাস আসে, বাস কাউন্টার থেকে বলল আশেপাশে থাকতে, অবশেষে দুপুর ১ টায় বাস আসলো, উঠে পড়লাম বাস এ।

চাঁদপুর থেকে আমাদের গন্তব্য বারইয়ারহাট হয়ে ঠাকুরদীঘি বাজার। মোট দূরত্ব ১৪৫ কিলোমিটার, সময় লাগবে ৩.৩০ ঘণ্টা। অনেক ক্লান্ত ছিলাম তাই চোখ বুজেই ঘুমিয়ে গেলাম, যখন ঘুম ভাঙল দেখলাম আমরা বারইয়ারহাট চলে এসেছি, সময় লেগেছে ৩ ঘণ্টা।

অবশেষে ভাগ্যদেবী প্রসন্ন হল আমাদের উপর। সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ ৩ ঘণ্টায় পৌঁছালাম। এই প্রথম ভালো কিছু। মনটা ভালো হয়ে গেল। নেমে গেলাম ঠাকুরদীঘি বাজার, ছোট্ট একটা বাজার কিন্তু প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুই আছে। ক্ষুধা লেগে গেছে সবার, খাবার হোটেল খুজে ঢুঁকে পড়লাম। মেন্যু হল ডিম এর ঝোল আর ডাল।

যারা ট্র্যাকিং এ পাহাড়ে যান তারা জানেন দুপুরে চরম ক্ষুধা পেলে পাহাড়ে এই ডিম-ভাত লাগে অমৃতের মত। বিশ্বাস করবেন না এই ডিম-ভাত-ডাল দিয়ে যেভাবে তৃপ্তি নিয়ে দুপুরে খাবেন, কোন ফাইভ স্টার এ বুফে তে ও এত তৃপ্তি পাবেন না। খাবার শেষে বের হলাম লেকের উদ্দেশে, হাতে অনেক সময়, তাঁবু হবে সেই সন্ধ্যায়। লেক পর্যন্ত যাওয়া যায় সিএনজি তে, কিন্তু যাবার পথ টা অনেক ভালো লাগলো, তাই সবাই মিলে হাঁটা শুরু করলাম, ২০-২৫ মিনিট পর পৌঁছে গেলাম লেকের গেটে।

ঠাকুর দিঘি থেকে মহামায়া লেক যাওয়ার রাস্তা
ঠাকুর দিঘি থেকে মহামায়া লেক যাওয়ার রাস্তা
চাইলে আপনিও হেঁটে যেতে পারেন
চাইলে আপনিও হেঁটে যেতে পারেন
২০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে ঢুঁকে পড়লাম ভেতরে, ঢুকে একটু হাঁটলেই সামনে পড়বে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম লেক মহামায়া। আহামরি কিছু না, তবে মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। এমনিতেই ২১ ফেব্রুয়ারি  ছুটির দিন, লোকে গিজ গিজ করছে, সবাই পিকনিক এ এসেছে বাস নিয়ে, বাজছে মাইক, চলছে শোরগোল। পাহাড়ের সেই নিস্তব্ধতা এখানে নেই। মেজাজ খারাপ হল চরম। ঘিঞ্জি ই যদি দেখতে হবে তবে ঢাকা কম ছিল কিসে! এত কাঠ খড় পুড়িয়ে কি লাভ হল।

কথা বললাম MKP এর শামিম ভাই এর সাথে, উনি শুনে একটু মুচকি হেসে বললেন, সন্ধ্যা পর্যন্ত একটু কষ্ট করে অপেক্ষা করেন। তার এই মুচকি হাসির রহস্য তখন বুঝি নি, বুঝেছি রাতে।

প্রায় ৫ টা বাজে, সবাই গোসল করতে নামলাম। লেকের পানি তো পুরা বরফগলা, অনেক ঠাণ্ডা। বেশিক্ষণ গোসল করা গেলো না। তবে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো এক নিমেষেই।

মহামায়া লেক
মহামায়া লেক
বিকালের মহামায়া লেক
বিকালের মহামায়া লেক
গোসলের পর বিশ্রাম
গোসলের পর বিশ্রাম
ঠাণ্ডা পানি থেকে উঠে পড়লাম, উঠে রেডি হয়ে শুয়ে পড়লাম লেকের পাশে কংক্রিট এর উপর, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সামনে শান্ত লেক, সমস্ত বাসের মাইক বন্ধ হয়ে গেছে, এবার শুরু হল আসল ব্যাপার।

লেকের উপর যে পাহাড়, ঠিক তার মাথার উপর থেকে একটা ছোট্ট লাফ দিয়ে উঠে পড়ল পূর্ণিমার কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। তখন বুঝতে পারলাম শামিম ভাই কেন হেসেছিল, পূর্ণিমা গেছে ২ দিন আগে, এখন চাঁদ তার আসল রুপ নিয়ে আছে, সামনে লেক, পাহাড়, মৃদু ঠাণ্ডা বাতাস আর তারা ভর্তি আকাশে কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ। মনটাই ভরে গেলো, সার্থক হয়ে গেলো এত ঝুঁট-ঝামেলা।

অপূর্ব মহামায়া
অপূর্ব মহামায়া
চন্দ্রালোকিত মহামায়া
চন্দ্রালোকিত মহামায়া
অনেকেই বলে পাহাড়ে জোৎস্না না দেখলে জীবন টাই বৃথা, এখানে তো পাহাড় আছেই, বোনাস হিসেবে আছে লেক ও ঝিরি ঝিরি বাতাস। কি লাগে আর। অবাক হয়ে থ মেরে বসে থাকলাম নিঝুম লেকের পাড়ে। চুপ চাপ...

একটু পর তাঁবু টাঙানো শুরু হল, আশেপাশে কোন আলো নেই, শুধু চাদের আলো, সেই চাদের আলোতে তাঁবু টাঙানো হচ্ছে। অদ্ভুত দৃশ্য, সেদিন সবমিলে ৪৫ জন লোক ছিল, আর তাঁবু ছিল ১২ টা। লেকের পাড়ে সারি সারি তাঁবু।

খোলা আকাশের নিচে
খোলা আকাশের নিচে
আমাদের তাঁবু
আমাদের তাঁবু
এরই ভেতর বয়সে ছোট, চেংড়া টাইপের ১০ জনের একটা গ্রুপ আসলো, এসেই বলল ভাই আমাদের তাঁবু টা যেন সবার থেকে দূরে হয়, কারন আমরা মজা করব। কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন করল কেমন ধরনের মজা? তারা বলল হাই লেভেল এর মজা, তো তাদের কথা মত তাঁবু দূরে করে দেওয়া হল। পরে মাঝ রাত এ শুনি বক্স এ শিলা কি জওয়ানি বাজে... বুঝুন অবস্থা...

রাত ৮ টায় খাবার দিল, খিচুড়ি আর মুরগির মাংস। খেয়ে তৈরি হলাম বারবিকিউ করার জন্য, ওরাই সব এনে বারবিকিউ করে দেয়, আপনার কাজ হবে শুধু খাওয়া। শুরু হল বারবিকিউ এবং ক্যাম্প ফায়ার। আড্ডা, গল্প, গান, ফটো সেশন সবই হল। আনন্দময়, অপার্থিব একটা রাত। শুধু চাদের আলো আর ক্যাম্প ফায়ার এর আগুনের লালচে ভৌতিক আলো, সাথে আছে বরফ শীতল হাওয়া।
রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষা
রাতের খাবারের জন্য অপেক্ষা
রাতের খাবার
রাতের খাবার
বারবিকিউ শেষ করতে করতে রাত ২ টা বাজলো, এর পর তাঁবুতে ঢুকে আড্ডা শুরু হল, কারন বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, এই বসন্ততেও ঠাণ্ডা। আড্ডা দিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম, কারন সকালে সূর্য উদয় দেখা ও কায়াকিং করতে হবে। সকাল ৬ঃ৩০ এ অ্যালার্ম দিয়ে ঘুমাতে গেলাম। বলা বাহুল্য ওখান থেকে ম্যাট, বালিশ আর কম্বল দিয়ে দেয়।

বারবিকিউ এর প্রস্তুতি চলছে
বারবিকিউ এর প্রস্তুতি চলছে
আমাদের এক বন্ধু
আমাদের এক বন্ধু
আমাদের ট্যুর ম্যানেজার
আমাদের ট্যুর ম্যানেজার
বারবিকিউ তৈরি
বারবিকিউ তৈরি
ভোর বেলায় ঘুম ভাঙল। তাবুর ফাঁকা দিয়ে সূর্য দেখা যাচ্ছে, রক্তিম সূর্য। দ্রুত বের হয়ে কিছু ছবি তুলে নিলাম। লেকের স্থির পানির উপর দিয়ে জলীয় বাস্প উড়ছে মেঘের মত করে, তার উপর ঠিকরে পড়ছে সূর্যের রক্তিম আলো। অন্যরকম এক ভাললাগে কাজ করে তখন...

ভোর এ মহামায়া
ভোর এ মহামায়া
তাঁবু
তাঁবু
তাঁবু ভিউ
তাঁবু ভিউ
কায়াকিং
কায়াকিং
কায়াকিং
কায়াকিং
কায়াকিং
কায়াকিং
কায়াকিং
কায়াকিং
এর পর সবাই উঠে রেডি হয়ে কায়াক নিয়ে বের হলাম, সাধারনত কায়াকে প্রতি ঘণ্টা ৩০০ টাকা করে রাখে, কিন্তু আমরা তাঁবুতে ছিলাম তাই আমাদের কাছ থেকে ২০০ টাকা করে রাখল... একেকটা কায়াকে ২ জন করে ধরে, বৈঠা দিয়ে কায়াক নিয়ে চলে গেলাম লেকের মাঝে। সোনালি আলোয় কায়াক করা, আসে পাশে বক আর পানকৌড়ির টুপটাপ ডুব দিয়ে ভেসে ওঠা। ২ ঘণ্টার মত কায়াক করে সকালের নাস্তার জন্য চলে আসলাম তীরে। এর আগে আমাদের অবশ্য কাপ্তাই লেক এ কায়াক করার অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু সেটা ছিল ভোর দুপুরে। তাঁবু থেকে সকালের নাস্তা দেওয়া হল পরটা, ডিম ভাজি ও ডাল। খেয়ে আর কিছুক্ষণ থাকলাম লেকের পাড়ে, শুক্রবার দিন, তাই সকাল থেকে দেখি পিকনিক বাস ভর্তি করে মাইক বাজিয়ে মানুষ আসছে, ভেঙে গেলো সব নিস্তব্ধতা। আমরাও বুঝলাম এখানে আমাদের আর মানাচ্ছে না। তল্পি তল্পা গুছিয়ে আমাদের নিরধারিত সকাল ১৯ টার বদলে ৯ টায় বের হয়ে পড়লাম মায়াবি মহামায়া লেককে পিছনে ফেলে, আর সাথে নিয়ে চললাম কিছু অপার্থিব স্মৃতি। ফিরে চললাম চিরচেনা সেই নগরী ঢাকার উদ্দেশে, আবার সেই একঘেয়েমি জীবন।


খরচ, যাতায়াত, থাকা, খাওয়াঃ

আবার মনে করিয়ে দেই আপনি যাচ্ছেন বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম লেক মহামায়া লেকে কায়াকিং এবং লেকের পাড়ে তাবুতে রাত্রিযাপন করতে।

কিভাবে যাবেন?

ঢাকা থেকেঃ
  • দেশের যেকোন জায়গা থেকে বাসে বা ট্রেনে করে প্রথমে পৌঁছাতে হবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের ঠাকুরদিঘী বাজারে। ঠাকুরদিঘী বাজার থেকে দু কিলোমিটার গেলেই রয়েছে ময়ামায়া লেক।
  • ঢাকা থেকে চট্টগ্রামগামী যেকোন বাসে করেই যেতে পারবেন মিরসরাই এর ঠাকুরদিঘী বাজারে। এস আলম, শ্যামলী, সৌদিয়া, ইউনিক , হানিফ সহ বেশ কয়েকটি বাস আসা যাওয়া করে এখানে। এসি/নন এসি ভেদে ভাড়া ৩৫০-৫০০/৮৫০-১১০০ টাকা। 
  • কমলাপুর থেকে বিআরটিসির বাসে আসতে পারেন। সায়েদাবাদ থেকে এসি, নন-এসি বাস সার্ভিস যেমন এস. আলম, সৌদিয়া, গ্রিন লাইন, সোহাগ, ইউনিক ইত্যাদিতে করে সরাসরি মিরসরাই, সেখান থেকে সিএনজি অথবা অটোরিকশাযোগে মহামায়া লেকে পৌঁছাতে পারেন। অথবা বাসে করেই ঠাকুরদিঘী বাজারে নেমে যাবেন।
  • ঢাকা থেকে ট্রেনে করেও আসতে পারেন এখানে। আন্তঃনগর ট্রেনে এসে ফেনী ষ্টেশনে নামতে হবে। ফেণী ষ্টেশন থেকে ১৫/২০ টাকার রিকশা নিয়ে মহিপাল বাস স্ট্যান্ড। ওখান থেকে লোকাল বাসে ৩০/৪০ টাকা খরচে ঠাকুরদিঘী বাজারে যেতে হবে। ট্রেণ ভাড়া শ্রেণিভেদে ২৬৫ থেকে ৮০০ টাকা পড়বে।
চট্টগ্রাম থেকেঃ
  • চট্টগ্রাম থেকে মহামায়া আসতে হলে মাদারবাড়ী ও কদমতলী বাস স্টপ থেকে মিরসরাই যাওয়ার বাস, সি এন জি, অটোরিক্সা ও মাইক্রোবাস রয়েছে। অলংকার সিটি গেইট থেকেও লোকাল বাসে চড়ে আসতে পারেন ঠাকুরদিঘী বাজার।
ঠাকুরদিঘী বাজার থেকে সিএনজি (জনপ্রতি-১৫ টাকা, রিজার্ভ-৭৫ টাকা) নিয়ে অথবা হেঁটে মহামায়া ইকোপার্কের মূল গেইটে যাবেন। আমরা হেঁটে গিয়েছিলাম। পার্কের প্রবেশ ফি-২০ টাকা। পার্কের ভিতেরই রয়েছে বাংলাদেশের ২য় বৃহত্তম লেক।


খরচঃ
  • কায়াকিং-প্রতি বোট ৩০০ টাকা/ঘন্টায় (২ জন) তবে যারা রাতে তাঁবুতে থাকে তাদের জন্য সাধারনত প্রতি বোট ২০০ টাকা করে দেওয়া হয়।
          ★স্টুডেন্ট আই ডি কার্ড প্রদর্শন সাপেক্ষে ডিসকাউন্ট রয়েছে।
  • ক্যাম্পিং-৬০০টাকা জনপ্রতি প্যাকেজ। এই প্যাকেজ এ থাকবে তাবু, বেড, বালিশ, কম্বল, রাতের খাবার, ক্যাম্প-ফায়াকিং, বারবিকিউ ( কোয়ার্টার ) সাথে পরটা ও সকালের নাস্তা)
     ★মহামায়াতে ক্যাম্পিং এ মেয়েদের থাকার অনুমতি নেই, কেবলমাত্র ছেলেরা থাকতে পারবে। মেয়েরা চাইলে আমাদের অন্য ২ টি প্রজেক্ট Sylhet-Ratargul Kayaking Point-SRKP এবং Rangamati-Chandrima Kayaking & Cycling Point-RCKCP এ যেতে পারবেন।

আরও জানতে বা বুকিং এর জন্য যোগাযোগ করতে পারেন।
শামীম-০১৮১৬১১০৩০০
সাইদুল-০১৬১৯৩৯৯৯১৫


রানা- ০১৬১৬৭৯৬৯৬৯


খাওয়া দাওয়াঃ
যারা রাতে তাঁবুতে থাকতে যাবেন তাদেরকে তো ঐখান থেকে রাতের খাবার ও পরের দিন সকালের নাস্তা দিবে। কিন্তু এর বাইরে যদি কেউ খেতে চান তবে জেনে রাখুন পার্কের ভেতর ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। নিজ থেকে খাবার নিয়ে যেতে হবে। পার্কের গেটের বাইরে একটা ভাতের হোটেল আছে। অর্ডার সাপেক্ষে তারা রান্না করে দেয়। এ ছাড়া ঠাকুরদিঘী বাজারে ছোট হোটেল আছে দেশী খাবার খেতে পারবেন। মিরসরাই ও সীতাকুণ্ড বাজারে গেলে মোটামুটি মানের আরো কিছু খাওয়ার হোটেল পাবেন সেখান থেকে খেয়ে নিতে পারবেন। সীতাকুন্ডের পৌরসভার সামনে আল আমিন হোটেলের বেশ সুনাম রয়েছে।

কোথায় থাকবেনঃ
তাঁবুতে যারা থাকতে যাবেন তাদের তো কোন চিন্তা নাই। তবে অন্যদের জন্য বলে রাখি, মিরসরাই এ থাকার মত তেমন ভালো কোন আবাসিক হোটেল নেই। থাকতে চাইলে মিরসরাই এর কাছে সীতাকুণ্ডে কিছু সাধারণ মানের হোটেল আছে সেখানে থাকতে পারবেন। হোটেল সৌদিয়ায় ৬০০ থেকে ১৬০০ টাকায় বিভিন্ন মানের রুম পাবেন এবং সাইমুন ও অন্য আবাসিক হোটেলে ৩০০ থেকে ৭০০ টাকায় থাকতে পারবেন। হোটেল সৌদিয়ায় বুকিং দিতে ফোন করতে পারেন 01991-787979, 01816-518119 নাম্বারে। তবে আরো ভালো কোথাও থাকতে চাইলে আপনাকে চট্রগ্রাম শহরে চলে যাওয়াই উত্তম। মিরসরাই থেকে চট্রগ্রাম যেতে ১ঘন্টা ৩০ মিনিটের মত লাগবে। অংলকার মোড়ে মোটামুটি মানের থাকার মত হোটেল পাবেন। অথবা চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এর স্টেশন রোড এলাকায় বিভিন্ন মানের হোটেল আছে, পছন্দ মতো কোন এক হোটেলে রাত্রিযাপন করতে পারেন।

আশেপাশের দর্শনীয় স্থানঃ

আপনার হাতে যদি সময় থাকে তবে ঘুরে আসতে পারেন আশেপাশের আরও কিছু স্পট এ। মহামায়া লেক ভ্রমণ করেও মিরসরাই ও সীতাকুন্ডের আশেপাশে যে সকল স্থান দেখতে পারেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু দর্শনীয় স্থান হলোঃ

  • খৈয়াছড়া ঝর্ণা
  • নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা
  • কমলদহ ঝর্ণা
  • সীতাকুন্ড ইকোপার্ক
  • চন্দ্রনাথ পাহাড়
  • ঝরঝরি ঝর্ণা
  • বাঁশবাড়িয়া সী বিচ
  • গুলিয়াখালি সী বিচ
  • কুমিরা সন্দ্বীপ ঘাট
এই সবগুলো স্পট নিয়ে আমার এই ব্লগ এ পোস্ট আছে, একটু কষ্ট করে খুজে নিতে হবে।

অবশেষে একটা কথা মনে রাখবেন,

ঘুরতে যেয়ে পদচিহ্ন ছাড়া কিছু ফেলে আসবো না
ছবি আর স্মৃতি ছাড়া কিছু নিয়ে আসবো না

Happy Traveling



Tour on budget
Budget travel
Cheap places to travel
বাংলাদেশ
খবর

========================================================================

মন্তব্য অথবা কোন প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করুন।

স্থানীয় দের ভাষ্য অনুযায়ী মহামায়া লেক টা তৈরি করা হয়েছিল পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে, কিন্তু পরে দেখা গেল যে এখান থেকে যতটুকু বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে সেটা দিয়ে বড়োজোর শুধু মিরসরাই উপজেলার চাহিদা মিটতে পারে, মানে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি। তাই পরবর্তীতে প্রকল্পটি বাদ দেওয়া হয়, এবং লেকের পানি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৃষিকাজের জন্য ব্যবহার করা শুরু হয়।

Post a Comment

[blogger]

Author Name

{picture#https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1196479430442738} YOUR_PROFILE_DESCRIPTION {facebook#https://www.facebook.com/alwasikbillah} {twitter#https://twitter.com/awasikb} {google#https://plus.google.com/112469283873821392454} {instagram#https://www.instagram.com/awasikb}

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.