ঘুরে আসুন দুর্গাপুরের বিরিশিরি থেকে

নীল-সবুজ পানির লেক 
আগেই বলে রাখি, এটি একটি বর্ণনা মূলক পোস্ট। এই পোস্টে দুর্গাপুরের বিরিশিরির প্রায় সকল তথ্য দেওয়ার চেষ্টা করেছি। তবে আমার নিজস্ব ভ্রমণ মূলক পোস্ট টি তে আমার নিজের ট্যুরের সকল প্রকার খরচ ও বর্ণনা পাবেন। পোষ্টটি পড়তে পারেন এখান থেকেঃ


আশা করি পোষ্টটি আপনাদের উপকারে আসবে।
তো চলুন শুরু করি আমাদের মুল পোস্ট।

নেত্রকোনা জেলার সর্ব উত্তরে ভারতের মেঘালয়ের গারো পাহাড়ের কোল ঘেসে নিরব দাড়ীয়ে ছোট্ট জনপদ দুর্গাপুর। একপাশে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলাঅন্য পাশে গারো পাহাড় আর উপত্যকা দিয়ে ঘেরা ভারতের মেঘালয়পুর্বে নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলা। আর দক্ষিণেপুর্বধলা উপজেলা। স্থানাঙ্ক: ২৫°৭.৫′ উত্তর ৯০°৪১.৩′ পূর্ব। ঢাকা থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার উত্তরে মেঘালয়ের পাদদেশে সীমান্ত ছোঁওয়া একটি উপজেলা সুসং দুর্গাপুর। এখানে আছে গারো পাহাড়, পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরি, সাদা মাটির পাহাড় ও নীল পানির লেক, পাহাড়ের ওপর রানিখং গির্জা, হাজং মাতা রাশিমনি স্মৃতিস্তম্ভ, আদিবাসী গ্রাম, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী, টঙ্ক স্মৃতিসৌধ সহ আরও অনেক কিছু।

বিরিশিরি নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী একটি গ্রাম। শুরুতে এটি ইউনিয়ন পরিষদের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও দুর্গাপুর পৌরসভা হওয়ার সাথে সাথে সদরের পার্শ্ববর্তী হওয়ায় গ্রামটিকে ওয়ার্ড হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। । ইংরেজ শাসন আমলে স্থাপিত শত বছরের পুরনো বয়েজ ও গালর্স হাই স্কুল, সরকারী কালচারাল একাডেমী, সোমেশ্বরী নদী, সাগর দিঘী, দুর্গাপুর রাজবাড়ী, পুরাকীর্তি নিদর্শন মঠগড়, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ আর দর্শনীয় স্খানগুলোর কারনে পর্যটকদের কাছে এটির যথেষ্ট সুনাম আছে। স্থানিয় অধিবাসীদের ৬০ ভাগ গারো আদিবাসী ৩০ ভাগ মুসলিম, বাকি ১০ ভাগ হিন্দু ও অন্যান্য জনগোষ্ঠী।

আপনারা যারা চিনামাটির পাহাড়, গারো পাহাড় বা সোমেশ্বরী নদী বলতে বিরিশিরি বুঝেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, দূর্গাপুর থানার একটি ইউনিয়ন বিরিশিরি । চিনামাটির পাহাড় ,রানিখং , সীমান্ত , সোমেশ্বরী নদী আরও যা দেখবেন সবই দূর্গাপুর থানার অন্তর্গত এবং অন্যান্য ইউনিয়ন এ । এবং আপনি বিরিশিরি ইউনিয়নের কোন কিছুতেই ঘুরবেন না. ফসলি মাঠ আর চোলাই মদ এর কারখানা ছাড়া বিরিশিরিতে আর কিছুই নেই - বেড়াতে যান দূর্গাপুর কিন্ত নাম হয় বিরিশিরির'র - বিরিশিরি তে বাস / নসিমন এসে থামে - এতটুকুই। এখানে বাসস্ট্যান্ড থাকায় এটি সারাদেশ ব্যাপী একটি পরিচিত নাম । অনেকে বিরিশিরিকে দুর্গাপুর শহর থেকে আলাদা মনে করেন। সোমেশ্বরী নদীই দুর্গাপুর ও বিরিশরিকে আলাদা করেছে ।

যেভাবে ঢাকা থেকে সুসং দুর্গাপুর যাবেনঃ

  • নাইটকোচঃ বর্তমানে ঢাকা থেকে দুর্গাপুরে আসার সবচাইতে সুবিধাজনক মাধ্যম হল নাইটকোচ। ঢাকা মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে দুর্গাপুরের উদ্দেশে রাত ১২ টা এবং ১ টায় ছেড়ে আসে এই নাইট কোচ গুলো। টার্মিনালে এসে টিকেট করা যায়, আবার ফোন করেও অগ্রিম বুকিং দেয়া যায়। রাত ১২ টায় মহাখালী টার্মিনাল থেকে নাইট কোচ ছেড়ে যায়। আগে থেকে যোগাযোগ করে টিকিট বুকিং দিয়ে রাখবেন। আবার ঢাকা ফেরার জন্য দুর্গাপুরের প্রাণকেন্দ্র তালুকদার প্লাজার সামনে থেকে রাত এগারটায় এবং সাড়ে এগারটায় দুটি নাইট কোচ ঢাকার উদ্দ্যশ্যে ছেড়ে যায়। আপনি এখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করে বাসে যেতে পারেন। ভোর পাঁচটার মধ্যেই মহাখালী পৌঁছে যাবেন। নির্ঝঞ্ঝাট এবং নিরাপদ ভ্রমন এর জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল সাজেশান। 
টিকিট বুকিং এর ফোন নাম্বারঃ
ঢাকা কাউন্টার: 01917710008 (এরশাদ)।
সুসং দুর্গাপুর কাউন্টার: 01711669774 (শিপার)।
রাত ১ টায় মামনি বাসের টিকেট অগ্রিম বুকিং দিতে কল করতে পারেন ০১৯১৭৭১০০০৮ নাম্বারে। টিকেটের মূল্য ৩৫০ টাকা করে। 
  • দিনের বাসঃ ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সুসং দুর্গাপুরে উদ্দেশ্যে দিনে ও রাতে বেশ কিছু বাস ছেড়ে যায়। এস এস এন্টারপ্রাইজ এর রনি নামের বাস টি মহাখালি থেকে সকাল ৭ টায় ছেড়ে যায়। আর নামিয়ে দেয় দুপুর ২ টায় সুসং দুর্গাপুর এর উৎরাইল বাজারে একেবারে স্বর্ণা গেস্ট হাউসের সামনে। বাসের এর নাম্বারঃ ০১৯৮৯৯০১০৪৯ (রুবেল/ফারুক বাসের সুপারভাইজার)
  • এছাড়া বলাকা কমিউটর নামে একটি লোকাল ট্রেন কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ভোর ৩.৪৫ এ জারিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে আসে। টিকেটের মূল্য ৮০ টাকা। জারিয়া থেকে আপনি অটো রিকশা, সিএনজি বা বাইকে করে আসতে পারবেন বিরিশিরি। 
  • বিআরটিসির একটি স্পেশাল বাস প্রতিদিন বিকাল ৩.২০ তে কমলাপুর বিআরটিসি কাউন্টার থেকে ছেড়ে যায় যা ছয় ঘন্টার মধ্যে আপনাকে সুসং দুর্গাপুরের একবারে প্রানকেন্দ্র উকিলপাড়া মোড় এর তালুকদার প্লাজা/ অগ্রণী ব্যাংক এর সামনে পর্যন্ত নিয়ে যাবে।কিন্তু স্থানীয় পরিবহন রাজনীতির কারনে প্রায়ই বাসটির সার্ভিস বন্ধ থাকে। 
  • আপনি ইচ্ছা করলে ময়মনসিংহ হয়ে ভেঙ্গে ভেঙ্গেও আসতে পারেন। অবশ্যি এতে ঝামেলা বেশি। “এনা” পরিবহন এর বাস মহাখালী হতে ময়মংসিংহ-এর মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যায়। এনা’র ভাড়া ২২০ টাকা। এছাড়া শেরপুর এবং ফুলবাড়িয়ার কিছু বাসে করে আপনি ময়মনসিংহ ব্রীজ পর্যন্ত আসতে পারবেন। ভাড়া ৯০/১০০ টাকা। তবে এক্ষেত্রে আপনি কাউন্টার থেকে না উঠে টারমিনাল এর বাইরে হতে বাসে উঠবেন। সেখান থেকে সিএনজি তে করে দুর্গাপুর বাজার তালুকদার প্লাজার সামনে এসে নামবেন। এই বাস গুলার ভাড়া কম এবং সার্ভিসও খুবই ভাল। তবে খরচ কমানোর জন্য সব বাস কিন্তু উপযুক্ত নয়। শুধু শ্যামলী বাংলা(শেরপুর), ইমাম(হালুয়াঘাট), এবং আলমএশিয়া(ফুলবাড়িয়া)। এছাড়া অন্য কোন বাসে ভুল করেও উঠবেননা। মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশা বা রিকশা নিয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু (শম্ভুগঞ্জ ব্রিজ নামে পরিচিত) মোড়ে চলে যাবেন, ব্রিজএর সামনে থেকে সুসং দুর্গাপুরে বাসে উঠে পড়লে পরের আড়াই/তিন ঘন্টা বসে বসে ঝাকি খাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এর পর সুসং দুর্গাপুরে পৌঁছালে নেমে রিকশায় গেস্ট হাউস এ। রাস্তা শ্যামগঞ্জ পর্যন্ত খুবই ভাল সুন্দর উন্নত এবং আরামদায়ক। শ্যামগঞ্জ থেকে ৩৫ কিলোমিটার রাস্তা কার্পেটিং ছাড়া। যদিও খানাখন্দ নাই খুবই ভারি ভারি বালু এবং কয়লার ট্রাক চলাচল করে বলে রাস্তা টেকেনা কিন্তু সবসময় ভেজা এবং সমান থাকে। বাস এর ভাড়া ৮০ টাকা। বাস থেকে সিএনজি ভ্রমন আরামদায়ক। সময় লাগে মাত্র দেড় ঘন্টা ভাড়া ১৫০ টাকা জন প্রতি। এক সিএনজি তে পাঁচ জন আসা যায়। 
  • আরেকটা রুট আছে যা ট্যুরিস্টদের কাছে মোটামোটি অজানাই এখনো। প্রাইভেটকার কিংবা মাইক্রো দিয়ে আসতে হলে আপনারা ময়মনসিংহ থেকে ধোবাউরা এবং ভেন্নাকান্দা চৌরাস্তা হয়ে শিবগঞ্জ বাজার দিয়ে একেবারে বিজয়পুরের বর্ডার সহ সব জায়গাতেই যেতে পারবেন। এতে আপনারা গাড়ি দিয়ে সরাসরি স্পটে যেতে পারবেন। 
যারা ঝটিকা সফর করতে চান তাদের জন্য সবচেয়ে ভাল হবে নাইট কোচে দুর্গাপুর এসে তালুকদার প্লাজার সামনে থেকে সারাদিনের জন্য বাইক ভাড়া করে(ভাড়া ৮০০/১০০) সবকিছু ঘুরে দেখে আবার নাইটকোচে ফেরত যাওয়া।

যারা ট্রেনে যেতে চান তাদের জন্যও ট্রেনের ব্যাবস্থা আছে। আন্তঃ নগর ট্রেনে ময়মনসিংহ পর্যন্ত যেতে পারেন এরপর আছে লোকাল ট্রেন জারিয়া এক্সপ্রেস ।ময়মনসিংহ পর্যন্ত রেল এর ভাড়া প্রথম শ্রেণী ১৮০ টাকা, চেয়ার কোচ ১৩০ টাকা এবং শোভন ১১০টাকা।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত পাঁচটি আন্তঃনগর ট্রেন চলে। কমলাপুর স্টেসন থেকে এগুলো যাত্রার

সময়সূচি হলঃ
ট্রেনের নাম 
ছাড়ার সময় 
ময়মনসিংহ জংশনে পৌঁছে
সাপ্তাহিক বন্ধ 
তিস্তা এক্সপ্রেস 
সকাল ৭.২০ 
সকাল ১০.৪৫ - ১১.০০ 
সোমবার 
অগ্নিবীণা এক্সপ্রেস 
সকাল ৯.২০ 
দুপুর ১.০০ - ১.৩০ 
নাই 
যমুনা এক্সপ্রেস 
বিকাল ৪.৪০ 
রাত্রি ৮.০০- ৮.৩০ 
নাই 
ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস 
সন্ধ্যা ৬.০০ 
রাত্রি ১০.০০ 
নাই 
হাওর এক্সপ্রেস 
রাত ১১.৫০ 
রাত ৩.০০ 
বুধবার রাত 

ময়মনসিংহ ষ্টেশনে নেমে কাউন্টারে খোঁজ করে জারিয়া-ঝাঞ্জাইল এর লোকাল ট্রেনে উঠে জারিয়া এসে নামতে হবে। ময়মনসিংহ হতে জারিয়া পর্যন্ত দিনে ৪ বার লোকাল ট্রেন চলাচল করে। সকাল ৬ টায় , সকাল ১১ টায়, বিকাল ৪ টায় , রাত ৮ টায়। ময়মনসিংহ হতে জারিয়া ট্রেন ভাড়া ১৮ টাকা। জারিয়া হতে দুর্গাপুর এর ভাড়া টমটম এ ২৫ টাকা , CNG তে ৪০ এবং মোটর সাইকেলে ৫০ টাকা প্রতি জন। তিস্তা এক্সপ্রেসে আসলে সকাল ১১ টার জারিয়ার ট্রেন ধরতে পারবেন আর হাওর এ আসলে দু ঘন্টা স্টেশন এ বসে থেকে ভোর ৬ টার জারিয়ার ট্রেন ধরতে পারবেন। যমুনা এক্সপ্রেস এ আসলে রাতের ৮ টার ট্রেন কোন দিন পাওয়া যায় আবার কোন দিন পাওয়া যায়না। জারিয়া স্টেশন হতে সকাল আটটায়, দুপুর একটায়, সন্ধ্যা ছয়টায় এবং রাত দশটায় ময়মনসিংহ স্টেশনের উদ্যেশ্যে লোকাল ট্রেন ছেড়ে যায়। গড়পড়তা সময় লাগে আড়াই ঘন্টা। আবার আপনি ইচ্ছা করলে নেত্রকোনার বাস কিংবা হাওর এক্সপ্রেসে করে শ্যামগঞ্জ এসে নামতে পারেন। ময়মনসিংহ থেকে তিন স্টেসন (ময়মনসিংহ-শম্ভুগঞ্জ- বিসকা-গৌরিপুর-শ্যামগঞ্জ) শ্যামগঞ্জ থেকে সিএনজি করেও দুর্গাপুর উকিল পাড়া মোড়ে তালুকদার প্লাজা/অগ্রণী ব্যাংক এর সামনে এসে নামবেন। ভাড়া ১০০-১২০ টাকা।

নতুন আগতদের জন্য সরাসরি বাস এ আসাই ভাল এতে ঝামেলা কম। 

দুর্গাপুর থেকে ঢাকা ফেরার উপায়ঃ

ঢাকা ফেরার জন্য দুর্গাপুরের প্রাণকেন্দ্র তালুকদার প্লাজার সামনে থেকে রাত এগারটায় এবং সাড়ে এগারটায় দুটি নাইট কোচ ঢাকার উদ্দ্যশ্যে ছেড়ে যায়। আপনি এখান থেকে টিকিট সংগ্রহ করে বাসে যেতে পারেন। ভোর পাঁচটার মধ্যেই মহাখালী পৌঁছে যাবেন। নির্ঝঞ্ঝাট এবং নিরাপদ ভ্রমন এর জন্য এটাই সবচেয়ে ভাল সাজেশান।
দুর্গাপুর থেকে ঢাকা ফেরত যাওয়ার সময় ট্রেনে যাওয়ার চিন্তা কখনই করবেননা। ময়মনসিংহ থেকে আপনি কখনো ঢাকার আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট পাবেননা। 

প্রতিদিন সকাল ৬.২০ এ সুসং দুর্গাপুরের একবারে প্রানকেন্দ্র উকিলপাড়া মোড় এর তালুকদার প্লাজা/ অগ্রণী ব্যাংক এর সামনে থেকে বিআরটিসি বাস ছাড়ে। অগ্রিম টিকিট এর জন্য কাউন্টার/এজেন্ট তামিম টেলিকম এ যোগাযোগ করে রাখবেন। 

যা যা দেখবেনঃ

  • চিনামাটির পাহাড় 
  • নীল/সবুজ পানির লেক 
  • গোলাপী পাহাড় 
  • গারো পাহাড় 
  • সোমেশ্বরী নদী 
  • রানিখং মিশন (সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী) 
  • ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত 
  • মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তৈরি সুড়ঙ্গ 

সুসং দুর্গাপুরের দর্শনীয় স্থান সমূহের বর্ণনাঃ 


  • গারো পাহাড়ঃ গারো পাহাড় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো-খাসিয়া পর্বতমালার একটি অংশ। এর কিছু অংশ ভারতের আসাম রাজ্য ও বাংলাদেশের নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত। গারো পাহাড়ের বিস্তৃতি প্রায় ৮০০০ বর্গ কিলোমিটার। সুসং দুর্গাপুর এর উত্তর সিমান্তে নলুয়াপাড়া, ফারংপাড়া, বাড়মারি, ডাহাপাড়া, ভবানিপুর , বিজয়পুর ও রানিখং সহ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এর বিস্তার। এই পাহাড়ে প্রচুর পরিমানে মুল্যবান শাল গাছ প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। এই পাহাড় গুলো প্রাকৃতিক মনোরম সৌন্দর্যের আধার। প্রকৃতি প্রায় ঝুলি উজাড় করে দিয়েছে এ গারো পাহাড়কে সাজাতে।
গারো পাহাড় 
বিচিত্র স্বাদের প্রকৃতির অলংকার যেন মানায় এই ভূস্বর্গকেই। পাহাড়-পর্বত, ছোট ছোট নদী, পাহাড়ী ঝরণা, শাল-গজারীসহ নানা প্রজাতির গাছ, সৌন্দর্য-মেশা উঁচুনীচু পথ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখার মজাই আলাদা। সবুজে সবুজে উদ্ভাসিত এই গারো পাহাড়। পাহাড়ের অসমতল উঁচুনীচু টিলার মধ্যদিয়ে বয়ে গেছে ঝরণা। যার স্বচ্ছ জলরাশিতে ভেসে ওঠে আগন্তুকের প্রতিচ্ছবি। দু'পাহাড়ের মাঝে মাঝে সমতল ভূমি। সমতল ভূমিতে সবুজ শস্য ক্ষেত। পাহাড়ে পায়ে চলার দুর্গম পথে চলাচল করে পাহাড়ী মানুষ। কোথাও কোথাও টিলার ওপর দেখা যাবে ছোট ছোট কুড়ে ঘর। সবুজ গাছের ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ। সব মিলিয়ে আল্লাহর সৃষ্টিতে ভরপুর এই পাহাড়। যা দেখে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ঝিনাইগাতীর এই পাহাড়ী এলাকায় বসবাস করে বিভিন্ন শ্রেণীর আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন। তার মধ্যে গারো, হাজং, কোচ, মুরং উল্লেখযোগ্য। এ সকল সম্প্রদায়ের লোকেরা যুগ যুগ ধরে নিজ নিজ কৃষ্টি-কালচার, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা লালন করে সৌন্দর্য ও সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। ঝিনাইগাতী উপজেলার উত্তর সীমান্ত হচ্ছে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষা। পাহাড়ী অঞ্চল হওয়ায় এখানকার আর্থসামাজিক অবস্থা অনেকটা ভিন্ন। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, ব্যবসা বাণিজ্যে সর্বক্ষেত্রে এ এলাকাটি পশ্চাদপদ। অধিকাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর। কৃষি অর্থনীতি মূলতঃ পাহাড়ের ঢালে বিভিন্ন প্রকার শাক-সবজি এবং নদী ও পাহাড়ী ঝরণা অববাহিকায় ধান চাষ হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যে পাথরের ও নদী থেকে উত্তোলিত বালির ব্যবসা প্রধান। এলাকার দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ প্রতিদিন সকালে কোদাল-সাবল, বাঁশের খাঁচা নিয়ে পাহাড়ে গর্ত খুঁড়ে খুঁড়ে পাথর তুলে পাথর ব্যবসায়ীদের নিকট বিক্রি করে অথবা দিনমজুরী হিসেবে শ্রম বিক্রি করে দিনাতিপাত করে। উপজাতিরা পাহাড়ে লাকড়ি কেটে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। পাথর উত্তোলনের ফলে দরিদ্র শ্রেণীর শ্রমিকদের উপকার হলেও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পাথর তোলাতে পরিবেশের ভারসাম্য দিন দিন নষ্ট হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ জরুরী। বর্তমানে গারো পাহাড়ের পতিত জমিতে, বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ফলের বাগান করা হচ্ছে। তাতে আম, কাঁঠাল, আনারস ও লেবু প্রচুর উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া মসলা জাতীয় ফসল যেমন হলুদ, আদাও প্রচুর হচ্ছে। সরকারিভাবে এসব উদ্যোগ গ্রহণ করলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রফতানি করা যেতো। এ পাহাড়ের গজনীতে গড়ে ওঠেছে ‘‘গজনী অবকাশকেন্দ্র’’। প্রতি বছর এখানে হাজার হাজার মানুষ পিকনিক, শিক্ষা সফরে আসে। সে সময় মুখরিত হয়ে ওঠে পাহাড়ী অঞ্চল। ভারতের সীমান্তঘেঁষা গহীন অরণ্য, মনোরম আবহাওয়া এবং বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল, উপজাতীয়দের সংগীতে মুখর। সব মিলিয়ে এলাকাটি আপনাকে দেবে অনাবিল আনন্দ। ছবির মতো সুন্দর এই গারো পাহাড়ের চূড়ায় ওঠে বসে দেখা যায় গভীর জঙ্গল। উত্তর দিকে চোখ দিলে দেখা যাবে ভারতের বেশ কিছু অংশ। উপজেলা সদর থেকে পাহাড়ী এলাকা বেশ দূরে হওয়ায় এখানের লোকজন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সেবা থেকে অনেকটা বঞ্চিত। তারপরেও রয়েছে বন্য হাতীর অত্যাচার। ফলে এখানকার জনসাধারণ আতংক ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে দিনাতিপাত করে। এতসব শংকার পরেও যারা পাহাড়ে ভ্রমণ করতে চায় তাদেরকে গারো পাহাড় নিশ্চিত আনন্দ দিবে উজাড় করে। 


  • ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমীঃ দুর্গাপুরের বাসস্ট্যান্ড এর পাশেই অবস্থিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী ।

ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী 
এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে। সুসং দুর্গাপুর ও এর আশপাশের উপজেলা কলমাকান্দা, পূর্বধলা, হালুয়াঘাট এবং ধোবাউড়ায় রয়েছে গারো, হাজং, কোচ, ডালু, বানাই প্রভৃতি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। এদের জীবনধারা যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি বৈচিত্র্যময় এদের সংস্কৃতিও। তাদের এসব ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং চর্চার জন্যই ১৯৭৭ সালে সুসং দুর্গাপুরে তৎকালীন রাস্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এর সময়কালে সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী । এখানে প্রায় সারা বছরই নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 


  • টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধঃ ১৯৪৬-৫০ সালে তখনকার জমিদার বাড়ির ভাগ্নে কমরেড মণিসিংহের নেতৃত্বে জমিদারদেরই বিরুদ্ধে শুরু হয় টঙ্ক আন্দোলন। 
টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ 
টঙ্ক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ, দুর্গাপুর টংক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত হয় স্মৃতিসৌধ। সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে কিছ দূর গেলে এম.কে.সি.এম হাই স্কুলের পাশে গেলেই চোখে পড়বে এ স্মৃতিসৌধটি। মরহুম রাজনীতিবিদ জালাল উদ্দিন তালুকদারের দানকৃত জমিতে এ স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মণিসিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে পাঁচ দিনব্যাপী মণিসিংহ মেলা নামে লোকজ মেলা বসে। 

  • সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী বা রানিখং মিশনঃ সুসং দুর্গাপুর থেকে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে রিকশায় যেতে হয় রানিখং গ্রামে। এখানে আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী।
রানিখং মিশনের চার্চ 
রানিখং মিশন 
রানিখং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। 

  • হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধঃ দুর্গাপুর বাজার থেকে বিজয়পুর পাহাড়ে যাওয়ার পথে কামারখালী বাজারের পাশে বহেরাতলীতে অবস্থিত রাশিমণি এই স্মৃতিসৌধ। সীমান্তবর্তী, গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ‘বগাঝরা’ নামক গ্রামটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী গ্রামগুলোর মধ্যে একটি।রাশিমণি সেই গ্রামেরই একজন প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন।ব্রিটিশ মহাজন ও জোতদারদের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং হয়ে ওঠেন টংক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী। টংক আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে কৃষক আন্দোলন। 
হাজং মাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ 
টংক মানে ধান কড়ারি খাজনা। টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক-বা না-হোক চুক্তি অনুযায়ী টংকের ধান জমির মালিককে দিতেই হত। ফলে কোন বছর যদি জমিতে ফসল না হয় বা খরা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে শস্য নষ্ট হয়ে যায় তবুও কৃষককে তার নির্ধারিত খাজনা পরিশোধ করতেই হত। এতে হাজংসহ অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায় এবং ওই অঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকসমাজ অর্থনৈতিকভাবে দুরবস্থায় পড়ে। টংকের ধান সময় মতো পরিশোধ করতে না পারলেই কৃষকদের ওপর নেমে আসত অত্যাচার-নিপীড়ন। টংকপ্রথা কৃষকদের জন্য ছিল একটি অভিশাপ। সে জন্য তারা টংকের হাত থেকে মুক্তির জন্য সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ বা আন্দোলন গড়ে তোলেন। রাশিমণির নেতৃত্বে হাজংরা প্রথমে টংকের কুফল বিষয়ে সচেতনায়নে গ্রামে গ্রামে বৈঠক করেন। পরে ঐকমত্য সৃষ্টি হলে কৃষকরা একপর্যায়ে জমিদারদের টংক ধান দেয়া বন্ধ ঘোষণা করেন। তৎক্ষণাৎ এর ফল হিসেবে টংক চাষিদের ভাগ্যে নেমে আসে দুর্ভোগ। মূলত হাজং কৃষকরা প্রথমে টংক প্রথা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রথমে তারা জমিদার গোষ্ঠীর সঙ্গে অতঃপর ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। হাজংদের এ টংক ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আন্দোলনের নেতৃত্ব দানে এগিয়ে আসেন কমরেড মণিসিংহ। ১৯৩৮ সাল থেকে টংক আন্দোলন শুরু হয় কিন্তু তার বহু পূর্ব থেকেই হাজংরা এ আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন; রাশিমণি হাজংয়ের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনা অঞ্চলে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, দুর্গাপুরে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এসব বাহিনী বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে বিদ্রোহী হাজং কৃষকসহ অন্য কৃষকদের খুঁজতে শুরু করে। সে লক্ষ্যেই ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০টার দিকে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস বাহিনী দুর্গাপুর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে বহেরাতলী গ্রামে তল্লাশি চালায়। কিন্তু এদিনে সে গ্রামের বিদ্রোহী কৃষক নর-নারীরা প্রতিবেশীদের টংকবিরোধী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। অবশেষে বহেরাতলী গ্রামে কাউকে না পেয়ে ক্ষিপ্ত বাহিনী লংকেশ্বর হাজংয়ের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী ও আন্দোলনকর্মী কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে ক্যাম্পের দিকে রওনা হয়। কুমুদিনী হাজং তখন মাত্র ১৭ বছরের নারী। হাজং গ্রামগুলোতে কুমুদিনীকে ধরার সংবাদটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে রাশিমণি তার হাজং নারী-পুরুষ দল নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর পথরোধ করেন। এ সময় বিপ্লবী রাশিমণি হাজং কুমুদিনী হাজংকে বাঁচাতে সেই সশস্ত্র বাহিনীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন এই বলে, ‘ময় তিমাদ, তিমাদ হুয়ে আরেগ তিমাদলা মান ময় বাঁচাব, মরিবা লাগে মুরিব।’ অর্থ: ‘আমি নারী, নারী হয়ে আরেক নারীর সম্ভ্রম রক্ষা আমিই করব, মরতে হয় মরব।’ সশস্ত্র বাহিনীও নৃশংসভাবে তাদের ওপর গুলি চালায়। ফলে এক সময় পেছন থেকে আসা গুলিতে রাশিমণি হাজং মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পেছনে পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাশিমণিকে ধরতে গেলে তাকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। বাকি আদিবাসীরা পুলিশদের মেরে ঘায়েল করা শুরু করলে অবশেষে তারা কুমুদিনীকে রেখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এভাবেই শহীদ হন আদিবাসী নেত্রী রাশিমণি হাজং। অধিকার প্রতিষ্ঠা ও একজন নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে তার এ আত্মত্যাগ আজও তাকে অমর করে রেখেছে। একজন নারী হয়ে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে জীবন বিসর্জন দিয়ে রাশিমণি এখন ‘হাজংমাতা’ হিসেবে পরিচিত। ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলী গ্রামের তার মৃত্যুসংলগ্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে ‘হাজংমাতা রাশিমণি স্মৃতিসৌধ’। প্রখ্যাত কবি রফিক আজাদ রাশিমণিকে নিয়ে তার ‘মাতা রাশিমণি’ কবিতায় লিখেছেন, ‘রাশিমণি একটি নাম, জীবন-সমান দীর্ঘ নাম। 

  • সাদা মাটির পাহাড় বা চিনামাটির পাহাড়ঃ দুর্গাপুর উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের শসার পাড় এবং বহেরাতলী গ্রামে সাদা মাটি অবস্থিত। 
সাদা/গোলাপী মাটির পাহাড় 
এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ নীল রঙের জলাধার গুলো দেখতে অত্যন্ত চমৎকার। বাংলাদেশের মধ্যে প্রকৃতির সম্পদ হিসেবে সাদা মাটির অন্যতম বৃহৎ খনিজ অঞ্চল এটি। ছোট বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ১৯৫৭ সালে এই অঞ্চলে সাদামাটির পরিমাণ ধরা হয় ২৪ লক্ষ ৭০ হাজার মেট্রিক টন, যা বাংলাদেশের ৩ শত বৎসরের চাহিদা পুরণ করতে পারে। চিনা মাটির প্রাচীন ইতিহাস না জানা গেলেও ১৯৫৭ সাল থেকে এ মাটি উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। ১৯৬০ সালে সর্বপ্রথম কোহিনুর এলুমিনিয়াম ওয়ার্কস নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই সাদামাটি উত্তোলনের কাজ শুরু করে। পরে ১৯৭৩ সালে বিসিআইসি সাদামাটি উত্তোলনে যোগ দেয়। বর্তমানে ৯টি কোম্পানী এই সাদামাটি উত্তোলনের কাজ করছে। প্রায় ৩০০ জন শ্রমিক এই মাটি উত্তোলনের সাথে জড়িত। বিভিন্ন রংয়ের মাটি, পানি ও প্রকৃতির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য মনকে বিমোহিত করে। সাদা, গোলাপী, হলুদ, বেগুনি, খয়েরী, নীলাভ সহ বিভিন্ন রংয়ের মাটির পাহাড় চোখকে জুড়িয়ে দেয়। সাদামাটি এলাকার আশপাশ জুড়ে বেশ কয়েকটি আদিবাসী বসতি রয়েছে তবে তারা সংখ্যায় অনেক কম। অধিবাসীদের অধিকাংশই বাঙালি মুসলমান। 


  • নীল/সবুজ পানির লেকঃ 
নীল/সবুজ পানির লেক 
নীল/সবুজ পানির লেক 

  • সোমেশ্বরী নদীঃ সোমেশ্বরী নদী স্বচ্ছ পানি আর ধুধু বালুচরের জন্য বিখ্যাত। সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলায় প্রবাহিত একটি নদী। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়ের বিঞ্চুরীছড়া, বাঙাছড়া প্রভৃতি ঝর্ণাধারা ও পশ্চিম দিক থেকে রমফা নদীর স্রোতধারা একত্রিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীর সৃষ্টি। । ৬৮৬ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে সোমেশ্বর পাঠক নামে এক সিদ্ধপুরুষ অত্র অঞ্চলকে বাইশা গারো নামের এক অত্যাচারী গারো শাসক এর হাত থেকে মুক্ত করে নেয়ার পর থেকে নদীটি সোমেশ্বরী নামে পরিচিতি পায়। মেঘালয় রাজ্যের বাঘমারা বাজার (পূর্ব নাম বঙ বাজার) হয়ে বাংলাদেশের রাণীখং পাহাড়ের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। রাণীখং পাহাড়ের পাশ বেয়ে দক্ষিণ দিক বরাবর শিবগঞ্জ বাজারের কাছ দিয়ে সোমেশ্বরী নদী বরাবর পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়।
সোমেশ্বরী নদী 
সেই পথে কুমুদগঞ্জ বাজার হয়ে কোনাপাড়া গ্রামের আব্দুল জলিল তালুকদার সাহেবের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাকলজোড়া, সিধলি, কলমাকান্দা, মধ্যনগর হয়ে ধনু নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সোমেশ্বরী। সোমেশ্বরীর মূলধারা তার উৎসস্থলে প্রায় বিলুপ্ত। বর্ষা মৌসুম ছাড়া অন্য কোন মৌসুমে পানি প্রবাহ থাকে না। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে পাহাড়ীয়া ঢলে সোমেশ্বরী বরাবর দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে নতুন গতিপথের সৃষ্টি করেছে। যা স্থানীয় ভাবে শিবগঞ্জ ঢালা নামে খ্যাত। বর্তমানে এ ধারাটি সোমেশ্বরীর মূল স্রোতধারা। এ স্রোতধারাটি চৈতালি হাওর হয়ে জারিয়া-ঝাঞ্জাইল বাজারের পশ্চিমদিক দিয়ে কংশ নদী সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ১৯৮৮ সালে পাহাড়ীয়া ঢলে আত্রাখালি নদী নামে সোমেশ্বরী নদীর একটি শাখা নদীটির সৃষ্টি হয়। সুসঙ্গ দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে আতরাখালী। কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। 

  • কংশ নদীঃ কংশ নদী ভারতের মেঘালয় ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের শিলং মালভূমির পূর্বভাগের তুরার কাছে গারো পাহাড়ে এই নদীটির উৎপত্তি। উৎস থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হওয়ার পর শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলা সদরের প্রায় ১৬ কি.মি. উত্তর দিয়ে কংস বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
কংশ নদী 
সেখান থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সোমেশ্বরী নদীতে মিশেছে। কংস ও সোমেশ্বরী মিলিত স্রোত বাউলাই নদী নামে পরিচিত। প্রবাহ পথে নদীটি ফুলপুর, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, পূর্বধলা, র্দুর্গাপুর, নেত্রকোনা সদর, বারহাট্টা, মোহনগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে 


  • আত্রাখালি নদীঃ আত্রাখালি নদী সুসঙ্গ দুর্গাপুর বাজারের উত্তর দিক দিয়ে সোমেশ্বরী নদী থেকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে।
আত্রাখালি নদী 
কিছু দূর এগিয়ে সোমেশ্বরীর মূলধারা সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আত্রাখালি নদী এখন বেশ খরস্রোতা। আবার সাম্প্রতিক সময়ে ২০১৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর আত্রাখালি থেকে নয়া গাঙ নামের আর একটি স্রোত ধারা উত্তর দিকে সৃষ্টি হয়েছে। 


দুর্গাপুর থেকে পাহাড়ে যাওয়ার উপায়ঃ
বিজয়পুর, রানীখং, বিজিবি ক্যাম্প এসব ঘুরতে রিক্সা অথবা মোটর সাইকেল ভাড়া করতে হবে। সোমেশ্বরী নদী পাড় হয়ে ওপাশে যেতে হবে। নদী পাড় হতে নৌকাকে দিতে হবে জনপ্রতি ৫ টাকা। আর মটর সাইকেল এর জন্য ১০ টাকা। মটর সাইকেল এ গেলে সব ঘুরে আসতে ৬ ঘন্টা মত সময় লাগবে। ১ টা মটর সাইকেলে ২ জন এর ভাড়া পড়বে ৭০০-১০০০ টাকা। আর রিক্সায় গেলে ২ জন এ খরচ পড়বে ৬০০-৮০০০ টাকা(যার কাছ থেকে যত রাখতে পারে)। ফিরতে সময় লাগবে ৮ ঘন্টা মত। তবে বর্ডারের রাস্তা ঘাট খুব সুবিধের না হওয়ায় মাটর সাইকেলে গেলেই ভাল হবে। আর ভবানিপুর ডাহাপাড়া যেতে হলে আত্রাখালি ঘাট হতে রিক্সা নিয়ে যাওয়া যায়। ১-১.৫ কিলোমিটার রাস্তা। চাইলে প্রাকৃতিক মনোরম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হেটেও যেতে পারবেন।

সুসং দুর্গাপুর বাজার থেকে রিক্সা বা মোটরসাইকেল নিয়ে সুনীল সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে, গারো পাহাড়, গোলাপী পাহাড়, নীল/সবুজ পানির লেক ঘুরে আসা যায়। সেখানে ভারত বাংলাদেশ বর্ডার ছাড়াও দেখার মতন রয়েছে একটা চার্চ ও মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ট্রেনিং নেয়ার জন্য তৈরী কয়েকটা পিলার । সারাদিনের জন্য রিক্সা ভাড়া পড়বে ৪০০ থেকে ৮০০ টাকার মধ্যে (যার থেকে যা রাখতে পারে)। রিক্সা আপনাকে খুঁজতে হবেনা, রিক্সাই আপনার হোটেলে এসে বসে থাকবে। আর মোটর সাইকেল ভাড়া পাওয়া যাবে তালুকদার প্লাজা/ অগ্রণী ব্যাংক এর সামনে থেকে।

শীত কালে যখন পানি কম থাকে তখন সোমেশ্বরী নদীতে হাটু পানিতে নেমে হাটা হাটি করবেন। ফিলিংস টা দুর্দান্ত হবে।

থাকার ব্যবস্থাঃ
সুসং দুর্গাপুরে থাকার জন্য ভাল মানের বেশ কয়েকটি গেস্ট হাউস আছে। আছে YMCA, YWCA, স্বর্ণা গেস্টহাউস, উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী ডরমেটরিসহ আরও কিছু গেস্ট হাউস। ডাবল রুম নন এসি ভাড়া ৬০০ টাকা, এসি ১২০০ টাকা প্রতিদিন। অগ্রিম বুকিং দেয়ার ব্যবস্থাও আছে। অগ্রিম বুকিং দিতে যোগাযোগ করতে পারেন এই নাম্বার গুলতে। 


  • স্বর্ণা গেস্টহাউস- ০১৭৪৮৯৬৪৩২২, ০১৭১৭০৩৩৯৯৮, ০১৮১৬১২১৮২১ 

  • YMCA (ইয়ুথ মেন খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন)- 01818613496, 01716277637, 01714418039, 01743306230, 01924975935, 01727833332। এখানকার কক্ষ ভাড়া ৩০০-৫০০ টাকা। 

  • YWCA- ০১৭১২০৪২৯১৬ (‘অমিতা সাংমা), রুম ভাড়া পড়বে ৭৫০ টাকা (২ বেড) আর চাইলে VIP রুম এর ব্যাবস্থাও করতে পারেন। এদের বিরাট একটা হলরুম আছে যেখানে একসাথে ১৮ জন থাকতে পারবে, সেক্ষেত্রে পার বেডে খরচ পড়বে ২০০ টাকা করে। YWCA এর ছাদটা সবচাইতে সুন্দর, সেখান থেকে পূর্ণিমা দেখতে অসাধারণ লাগে। 

  • গারো ব্যাপ্টিস্ট কনভেন্সন- ০১৭১৩৯৩২৮১১, ০১৭৪৯৭৩৯২৪৭ 
  • জেলা পরিষদ ডাক বাংলা: 01558380383, 01725571795 
  • ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমী গেষ্ট হাউজ। ফোনঃ 09525-56042; মোবাইলঃ 01815482006 
অন্যান্য গেস্ট হাউসঃ
এছাড়া দুর্গাপুরে আরও কিছু মধ্যম মানের হোটেল আছে,

  • হোটেল সুসং -০১৯১৪৭৯১২৫৪ 
  • হোটেল গুলশান-০১৭১১১৫০৮০৭ 
  • হোটেল জবা-01711186708, 01753154617 
  • নদীবাংলা গেষ্ট হাউজ-01771893570, 01713540542) 
এসব হোটেলে ১৫০-৪০০ টাকার মধ্যে থাকার ব্যাবস্থা আছে। আপনি বনে জঙ্গলে থাকতে এসে পাচ তারকা হোটেল এর সার্ভিস আশা করতে পারেন না। তবে আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি তাদের আন্তরিকতা এবং সেবা আপনাদের ভাল লাগবেই।

খাওয়া দাওয়াঃ
খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা নিয়ে আপনাদের একেবারেই চিন্তা না করলেও চলবে। যে গেস্ট হাউস এ থাকবেন তারাই সুলভ মুল্যে ভাল খাবারের ব্যাবস্থা করে দিবে। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংক/ তালুকদার প্লাজার সামনে অবস্থিত হোটেল শান্ত এবং হোটেল পুস্প তে ভাল মানের এবং সুলভ মুল্যে খাবার পাওয়া যায়।
তবে বলে রাখি আপনি যেই গেস্ট হাউসেই থাকেন না কেন আর যেখানেই খাবার খান না কেন, স্বর্ণা গেস্ট হাউজের মিক্সড সবজি টা খেতে ভুল করবেন না। আশা করি মনে রাখার মত একটা খাবার হবে। 

Post a Comment

[blogger]

Author Name

{picture#https://www.facebook.com/photo.php?fbid=1196479430442738} YOUR_PROFILE_DESCRIPTION {facebook#https://www.facebook.com/alwasikbillah} {twitter#https://twitter.com/awasikb} {google#https://plus.google.com/112469283873821392454} {instagram#https://www.instagram.com/awasikb}

Contact Form

Name

Email *

Message *

Powered by Blogger.