কলকাতা |
অবশ্য যশোরের সব রাস্তার একই অবস্থা। বেনাপোলের মাত্র ৩৮ কিঃমিঃ আসতে লাগলো সোয়া এক ঘন্টারও বেশি। ইমিগ্রেশনে আমার পরিচিত এক দালাল আছে। ফোন দিলাম তাকে। সে জানালো যে সে আসতে পারবে না, তার বদলে অন্য একজনকে পাঠিয়ে দিচ্ছে। কি আর করা যাবে! আসলো সে দালাল। সে আমার পাসপোর্ট নিয়ে ট্রাভেল ট্যাক্স জমা দিলো। এরপর দালালটার কাছে আমার সব টাকা-পয়সা জমা দিয়ে দিলাম। এর ফলে কাস্টমসে চেক করলে আমার কাছে কোন টাকা পাবে না। ইন্ডিয়ায় ঢুকে অন্য দালালের কাছ থেকে রুপি নিয়ে নেব।
সব কাজ শেষ হলে প্রথমে বাংলাদেশ কাস্টমস পার হলাম। তারপর বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন পার হয়ে জিরো পয়েন্টে গেলাম। আমার বাবা দেখি বাংলাদেশ সিমান্তে দাঁড়িয়ে আছে, তার উদ্দেশ্যে শেষবারের মতো হাত নেড়ে ঢুকে গেলাম ভারতে।
ইন্ডিয়ান কাস্টমসে বিরাট লম্বা লাইন। তারা প্রথমে সকল যাত্রীর ব্যাগ মেশিন দিয়ে চেক করে তারপর সেই ব্যাগগুলো খুলে সব জিনিস-পত্র নামিয়ে হাতড়ে হাতড়ে চেক করছে। অবশেষে আমার পালা যখন এলো প্রথমেই তারা আমাকে বড়সড় আকারের সন্দেহ করে বসলো। তাদের প্রশ্ন হচ্ছে, আমি একজন মানুষ অথচ আমার ব্যাগ এতো মোটা কেন? বাড়ি থেকে বের হবার সময় কৌতুহলবশত ব্যাগটার ওজন মেপে দেখেছিলাম সাড়ে ১৮ কেজি। তো তাদেরকে বোঝালাম যে, আমি দার্জিলিং যাবো তো এজন্য অনেকগুলো সোয়েটার রয়েছে। কারণ দার্জিলিং হচ্ছে ঠান্ডার জায়গা। ব্যাটাকে কাশ্মিরের কথা বললে ভাবতো আমি খুব বড়লোক। তাহলে আমার কাছ থেকে টু-পাইস কামিয়ে নেবার ধান্দা করতে পারত, এজন্য কাশ্মিরের বদলে দার্জিলিংয়ের কথা বলেছিলাম। তো কাস্টমস ব্যাটা দেখি আমার কথা বিশ্বাস করে আমার ব্যাগ না খুলেই ছেড়ে দিলো।
এপাশ থেকে এক কুলি হয়েছে আমার ইন্ডিয়ান পথ প্রদর্শক। কাস্টমস চেকিং শেষে সে আমাকে নিয়ে গেল একটা ফরম পূরণ করতে। সেখানে ১০ টাকা গচ্চা দিতে হলো ফরম পূরণ বাবদ। এরপর গেলাম ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনে। এখানে বেশি সময় লাগলো না। ইমিগ্রেশন শেষে এপাশের দালালের ঘরে এলাম। কে পি ঘোষ, একদম দরজার গোড়ায় এই দোকানটি। এখান থেকেই রুপি নেবার কথা। ব্যাটারা এতো খারাপ, আমার কাছ থেকে বেশি দাম নিয়েছে। ১০০ টাকায় আমি পেয়েছি মাত্র ৮২ রুপি। যেখানে অন্যান্য দোকানে পাওয়া যাচ্ছে ৮৩ রুপিরও বেশি। শুনতে লাগে মাত্র ১ রুপি কম-বেশি, কিন্তু ৫০,০০০ টাকা ভাঙ্গালে প্রায় ১,০০০টাকা লস হয়। আমি দেশ থেকে আমার সবগুলো প্যান্টের ভিতরের অংশে দুটি করে পকেট বানিয়ে নিয়ে এসেছি। মন খারাপ করে পাসপোর্ট আর রুপিগুলো সেখানে ঢুকিয়ে ফেললাম। একটা কথা বলে রাখি, এইসব দালাল আর কুলি না ধরে নিজের কাজ নিজে করলে কোন সমস্যা নেই, বরঞ্চ অনেকগুলো টাকা বেঁচে যায়। কিন্তু আমার বাবা আমাকে এতো ভালোবাসে যে আমার যেন কোন সমস্যা না হয় সেজন্যই এই ব্যাবস্থা।
জিপি সিম দিয়ে শেষবারের মতো বাবার সাথে কথা বলে উঠে বসলাম অটোতে। এই অটোগুলো বনগাঁ স্টেশন পর্যন্ত যায়। সময় লাগে ২০ মিনিটের মতো। বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় ঢুকলে প্রথমেই যে সুবিধা পাওয়া যায় তা হচ্ছে সময়ের। ওরা আমাদের থেকে আধাঘন্টা পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ সময় অনুযায়ি সাড়ে নটায় ঢুকলেও ভারতে তখন সকাল নটা বাজে।
অটো থেকে বনগাঁ স্টেশনে নেমে টিকিট কাউন্টারে গেলাম। বনগাঁ থেকে শিয়ালদা যাবার অনেকগুলো ট্রেন আছে। ভাড়া ২০ রুপি। কিছুক্ষণ পরপরই ট্রেন ছাড়ে। তবে পার্ক স্ট্রীট বা নিউ মার্কেট যেতে হলে বনগাঁ থেকে উঠে দমদমে নামা ভালো। ভাড়া ১৫ রুপি। দমদমে নেমে প্ল্যাটফর্ম বদলে মেট্রোতে উঠতে হবে। পার্ক স্ট্রীট যেতে হলে পার্ক স্ট্রীট স্টেশন, নিউ মার্কেট যেতে হলে এসপ্ল্যানেড, আর পিয়ারলেস হাসপাতাল যেতে হলে কবি সুভাষ স্টেশনে নামতে হবে। মেট্রো ট্রেনের ভাড়া সর্বচ্চো ২৫ রুপি।
তবে আমি কাটলাম বিবাদি বাগ স্টেশনের টিকিট। কারণ আমি যাবো ফেয়ারলি প্লেস। ফেয়ারলি প্লেসে ফরেন কোটায় সারা ইন্ডিয়ার ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়। যেখানে সাধারণ ভারতীয়দের কোন দূরপাল্লায় যেতে হলে চার মাস আগে থেকে ট্রেনের টিকিট কাটতে হয় সেখানে বিদেশিরা যাত্রা শুরুর চার ঘন্টা আগেও ফরেন কোটায় টিকিট পেতে পারে। এ থেকেই বোঝা যায় ইন্ডিয়ান সরকার পর্যটনে কতোটা মনযোগী। কলকাতায় ফরেন কোটায় ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায় ফেয়ারলি প্লেসে। আর বিবাদি বাগ স্টেশনের সঙ্গেই ফেয়ারলি প্লেস। বনগাঁ স্টেশন থেকে ৯’৫০ এর মাঝেরহাট লোকাল ট্রেনটি দমদম থেকে শিয়ালদার দিকে না গিয়ে ডানদিকের পথ ধরে হুগলি নদীর ধার দিয়ে মাঝেরহাট স্টেশনে যায়। মাঝেরহাটের কয়েক স্টপেজ আগেই পড়ে বিবাদি বাগ স্টেশন।
টিকিট কেটে ট্রেনের একদম শেষের বগিতে উঠে বসলাম। কারণ সমনের বগিতে অতিরিক্ত ভিড় হয়। ভারতের লোকাল ট্রেনগুলোতে মহিলাদের জন্য আলাদা বগি সংরক্ষিত থাকে। সেই বগিতে কোন পুরুষ উঠলে তার কপালে ভয়াবহ দুঃখ আছে। গবদা গবদা মহিলা পুলিশ এসে সেই পুরুষগুলোকে আচ্ছামতো পিটায়। তবে সাধারণ বগিতে নারী-পুরুষ সবাই উঠতে পারে। এটা সেই সংরক্ষিত বগি না এটা নিশ্চিত হয়ে আমার মোটা ব্যাগটাকে সিটের নিচে চালান করে দিয়ে জানালার ধারে আরাম করে বসলাম।
একেবারে ঠিক সময়েই ট্রেন চলা শুরু হলো। দুপাশের দৃশ্য বাংলাদেশের মতো। সবুজ ধানক্ষেত। তবে মাঝে মাঝে যে দুয়েকটি বাড়ি-ঘর দেখা যাচ্ছে তা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক নিম্নমানের। পাঁচ-ছটা স্টেশন যাবার পর দম বন্ধ হয়ে গেল। এতো ভিড় যে ভয়ঙ্কর অবস্থা। তারই মধ্যে কেউ কেউ তাস খেলছে আর চিল্লাপাল্লা করছে। আর এদের বাংলা উচ্চারণ এতো বিদঘুটে আর নাকে নাকে যে কিছুক্ষণের মধ্যে মাথা ধরে যায়। একজন তো আমি সিটের নিচে ব্যাগ রেখেছি কেন এজন্য আমার সাথে রাগারাগি শুরু করে দিলো। একেকটি স্টেশন আসছে আর ঝাপিয়ে ঝাপিয়ে আরো লোক উঠছে।
বয়স্ক মহিলা যাত্রীদের অবস্থা দেখে সত্যিই খুব খারাপ লাগে। কিন্তু এখানকার লোকগুলো দেখি নিরবিকার। আমি যে তাদের আমার জায়গায় বসতে দেব, এমন অবস্থাও নেই। ভাগ্যিস আমি জানালার পাশে বসেছি বলে কিছুটা বাতাস পাচ্ছি। কিন্তু অন্যদের অবস্থা ভয়ঙ্কর। আবার এরই মধ্যে দেখি কিছু লোক ঘুমাচ্ছে। আমাদের দেশে লোকে যেমন বাসে মাথা পেছনে হেলিয়ে মুখ উঁচু করে হাঁ করে ঘুমায় তেমনটি নয়; এরা চিবুকটা বুকের কাছে ঠেকিয়ে ঘুমাচ্ছে আর ট্রেনের দুলুনির সাথে সাথে দুলছে। নির্দিষ্ট স্টপেজের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে উঠে আড়ামোড়া ভেঙে এই ভয়ঙ্কর ভিড় ঠেলে দরজার কাছে গিয়ে দাড়াচ্ছে। আমি খুব অবাক হলাম এই ভেবে যে, এদের নামার ঠিক ৫ মিনিট আগে ঘুম ভাঙ্গে কিভাবে!
ঘন্টা দেড়েক পর ট্রেন যখন দমদম জংশন আসলো তখন কিছুটা স্বস্তি পেলাম। কারণ অধিকাংশ লোক নেমে গেল মেট্রো ট্রেন ধরতে। এবার একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসলাম। এতোক্ষণ ৮জনের সিটে ১৫জন বসে ছিলাম আর গায়ের উপর দাঁড়িয়ে ছিল আরো পাচ-ছজন। স্টেশনের এক মহিলা দেখি পূজো শেষে ট্রেনের জানালা দিয়ে সবাইকে প্রসাদ বিতরণ করছে। এতোক্ষণ ধরে চিল্লাপাল্লা করা লোকগুলি কি ভক্তিসহকারে সেই প্রসাদ চেয়ে নিলো, তারপর আরো ভক্তিসহকারে সেগুলি গলাধঃকরন শুরু করলো।
বাংলাদেশ বর্ডার পার হয়ে ইন্ডিয়ায় ঢুকলেই প্রথমে যে জিনিসটা আলাদাভাবে চোখে পড়ে তা হচ্ছে এখানকার মহিলারা। এরা খুব পরিশ্রমী এবং এরা পুরুষদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে। এখানকার মহিলারা খুব সাইকেল চালায়। এমনকি বয়স্ক মহিলাদের পর্যন্ত আমি শাড়ি পরে সাইকেল চালাতে দেখেছি। বাংলাদেশের মেয়েদের মতো এদের মধ্যে ন্যাকা ন্যাকা ভাব নেই। খুব ভীড়ের মধ্যে পুরুষদের সাথে যুদ্ধ করে এরা ট্রেনে চাপে। তবে এদের রুচিবোধ কিছুটা নিম্নমানের। এরা খুব সস্তা ধরণের পোষাক-আশাক পড়ে। এদের মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলারা পর্যন্ত এতো সস্তা দামের শাড়ি পড়ে যে আমাদের দেশের কোন বাড়ির কাজের মহিলাকে ৫০০টাকা দিলেও সেই শাড়ি পড়তে রাজি হবেনা।
তাছাড়া এদের শাড়ি পড়ার ধরণটিও অন্যরকম। বিশেষ করে হিন্দু মহিলাদের। এদের শরীরের বেশিরভাগ অংশই উন্মুক্ত থাকে। আর এ নিয়ে তাদের মাঝে কোন বিকার নেই। কলকাতার বেশিরভাগ মহিলারা শাড়ি পরে। আবার অনেক বয়স্ক মহিলা থ্রী-কোয়ার্টার প্যান্ট আর গেঞ্জি পড়ে ঘুরে বেড়ায়। বেঢব আকৃতির এসব মহিলাদের দেখতে যে কি বীভৎসই লাগে। এমনকি এখানকার অল্পবয়সী মেয়েরা অনেক খোলামেলা হলেও ততোটা সুন্দর নয়। অথচ বাংলাদেশী মেয়েরা দেখতে কতো সুন্দর।
তো ট্রেন দমদম জংশন ছাড়িয়ে আবার চলা শুরু করলো। দমদম স্টেশনের কিছু পরেই চিতপুর স্টেশন, যেটির আরেক নাম হচ্ছে কলকাতা স্টেশন। এই স্টেশন থেকেই আন্তর্জাতিক মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনটি চলাচল করে। কলকাতা স্টেশন ছাড়ানোর পরই ট্রেন হুগলি নদীর ধার দিয়ে চলা শুরু করে। হুগলি নদীর চলিত নাম হচ্ছে গঙ্গা নদী। এই জায়গাটি আমার কাছে খুব ভালো লাগে। ডানদিকে গঙ্গা নদী আর বাদিকে পুরানো কলকাতার দুশো-তিনশো বছরের পুরানো তিন-চার তলা বাড়ি আর ট্রাম রাস্তা। ট্রেনের জানালা দিয়ে ঘড়ঘর শব্দ করে ট্রামের ছুটে চলা দেখছি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট স্টেশন। শোভাবাজার, বড়বাজার এরকম আরো কয়েকটি স্টপেজ পার হয়ে পৌছে গেলাম বিবাদি বাগ স্টেশনে। বনগাঁ থেকে আসতে প্রায় দু’ঘন্টা লাগলো। স্টেশনটির ডানদিকে নদী,যেটি পার হলেই বিখ্যাত হাওড়া স্টেশন। আর বাম দিকে বাইরে বের হলেই ফেয়ারলি প্লেস।
ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকে বাইরে বের হলাম। রাস্তা পার হলেই ফেয়ারলি প্লেস ভবন। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর বিদেশীদের জন্য নির্ধারিত জায়গাটি খুজে পেলাম। কাঁচের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলাম। দু’জন নিরাপত্তাকর্মী আমার পাসপোর্ট চেক করলো। শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বিরাট হলরুমটি খুব পরিচ্ছন্ন। একটা অংশে মৈত্রী ট্রেনের টিকিট আর অন্য অংশে বিদেশীদের জন্য ভারতীয় ট্রেনের টিকিট বিক্রি হচ্ছে। ঘরটির এককোনে পরিচ্ছন্ন একটা টয়লেটও আছে।
পরবর্তী পর্ব
========================================================================
মন্তব্য অথবা কোন প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করুন।
Post a Comment