কাঞ্চনজঙ্ঘা |
কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম পঞ্চগড় থেকে। আর স্পস্ট দেখে এলাম সকালের সোনালি রোদে চকচক করতে থাকা সপ্নের কাঞ্চনজঙ্ঘা। দেখতে অপূর্ব, কিন্তু এটাকে দার্জিলিং এর সাথ তুলনা করাটাও বোকামী নিশ্চই। কারন একেক যায়গার ভিউ একেক রকম। সেটা তুলনা যোগ্য নয়। তবে ছবিতে যতটুকু দেখেছি, বা যতটুকু কল্পনা করেছি তার থেকে অনেক বেশি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি আমি।
কাঞ্চনজঙ্ঘা হিমালয়ান পর্বতমালার তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ আর ভারতে সর্বোচ্চ যার অবস্থান ভারত নেপাল সীমান্তে । কাঞ্চনজঙ্ঘার নামটি স্থানীয় শব্দ “কাং চেং জেং গা” থেকে এসেছে, যার অর্থ তেনজিং নোরগে তাঁর বই, ম্যান অফ এভারেস্ট (Man of Everest)- এ লিখেছেন “তুষারের পাঁচ ধনদৌলত” । কাঞ্চনজঙ্ঘার উচ্চতা ৮,৫৮৬ মিটার (২৮,১৬৯ ফুট) মাউন্ট এভারেস্ট এর উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার যা চীন ও নেপাল সীমান্তে অবস্থিত বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ।
আমাদের ট্যুর বর্ণনাঃ
বৃহঃবার রাত ৮ টায় পঞ্চগড়ের বাসে চড়ে বসি। বাস ছিল বাবলু, ভাড়া ছিল ৪৫০/-
সময় লাগবে কম বেশি ৭-৮ ঘণ্টা, গাজীপুরে জ্যাম থাকার কারনে আমাদের সময় বেশি লেগেছিল।
সকাল ৮.৩০ টায় পঞ্চগড় পৌঁছে নাস্তার জন্য সময় নস্ট না করে সোজা তেতুলিয়া টু বাংলাবান্ধার বাসে চড়ে বসি এবং নেমে যাই তেতুলিয়া ডাক বাংলো। ভাড়া ছিল ৫৫ টাকা। সময় লাগে ৪০-৫০ মিনিট এর মত।
কন্টাক্টর কে বলে রাখি তেতুলিয়া ডাক বাংলোর কাছে নামিয়ে দিতে। রাস্তার পাশেই মহানন্দা নদীর পাড়েই ডাক বাংলো। এখান থেকেই কাঞ্চনজগা বেশ ভাল দেখা যায়।
এর পর নাস্তা করার জন্য ডাক বাংলো থেকে ভ্যানে করে আসি তেতুলিয়া বাজার। ভাড়া জন প্রতি ৫ টাকা। নাস্তা করে তেতুলিয়া বাজার থেকে উঠে পরি বাংলাবান্ধার বাসে। তেতুলিয়া থেকে বাংলাবান্ধা ২০ টাকা। সময় নেয় ২০- ৩০ মি।
বাংলাবান্দা থেকে জিরো পয়েন্ট যেতে হয় অটোতে করে। ভাড়া জন প্রতি ১০ টাকা।
সেখানে ঘণ্টা খানেক সময় অবস্থান করে বাংলাবান্ধা বাস স্ট্যান্ড থেকে চলে যাই রউশন পুর বাস স্ট্যান্ড। ভাড়া ছিল ৩৫ টাকা। সেখান থেকে ভ্যানে করে যাই কাজী এন্ড কাজী টি স্টেট এ। ভাড়া ছিল আপ ডাউন ৫০ টাকা।
কাজী এন্ড কাজী টি স্টেট এ অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলি। জায়গাটা ভাল লেগেছে। তবে বলে রাখি আমরা যেসময় গিয়েছিলাম (২০১৬ সালে) তখন ঢুকতে অনুমতি নিয়ে যেতে হত। আমার এক বন্ধুর চাচা ঐখানকার এম.পি ছিলেন তাই আমাদের অনুমতি পেতে কোন সমস্যা হয় নি। কাজী এন্ড কাজী টি ইস্টেড দেখে যথারীতি চলে আসি রউশন পুর বাস স্ট্যান্ড।
সেখান থেকে বাসে করে চলে যাই বোর্ড বাজার নামক জায়গায়। ভাড়া ২৫ টাকা। সময় লাগে ৩০ মি দুপুরে সেখানেই খাই। খাবার খরচ হয় ৮০ টাকা( ভাত ২০, আলু ভর্তা ১০, মুরগি ৪০, ডাল ১০)। তারপর ভ্যান ভাড়া করে যাই ভিতরগর ও মহা রাজার দীঘি দেখতে। ভাড়া যাওয়া- আসা ৪০ টাকা নেয়। দিঘিতে গোসল ও পুরো দীঘি ঘুরে দেখতে গিয়ে প্রায় সন্ধ্যা করে ফেলি। তাই রক মিউজিয়াম আর দেখতে পারি নাই। তাই সবাই এই বিষয়টি মাথায় রাখবেন।
রাতের বাসে ঢাকা ফিরে আসি, বাস ছিল তানজিলা চেয়ার কোচ , ভাড়া ছিল ৪০০ টাকা। ভাড়ার তুলনায় বাস অনেক ভাল ছিল। হানিফ শ্যামলীর চেয়ে খারাপ ছিল না।
আমার মোট খরচ হয়ে ছিল- ১,৩৫২/- টাকা।
এতো গেল আমার মত ব্যাচেলর দের বাজেট ট্যুর প্ল্যান, এবার আসি বিস্তারিত ভাবে...
যেভাবে যাবেন:
ঢাকা থেকে পঞ্চগড় প্রায় ৪৭৫ কিলোমিটার যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রুট। ঢাকা থেকে সকাল,সন্ধ্যা ও রাতে তেতুলিয়া ও পঞ্চগড় এর সরাসরি বাস আছে। শ্যামলী / আসাদগেট / কল্যাণপুর থেকে সব ভালো গাড়ীই যায়।
- বাসঃ হানিফ,শ্যামলী,নাবিল,বাবলু,বি আর টি সি,হক
- বাস ভাড়াঃ ৬০০-৬৫০ টাকা এবং ১০০০-১৫০০টাকা(এসি )
তেতুলিয়ার একটু ফাঁকা যে কোন যায়গা থেকেই দেখা যায় এই দৃশ্য, তবে ডাক বাংলো থেকেই বেশিরভাগ মানুষ দেখে থাকে। তবে পঞ্চগড় শহর থেকেও দেখতে পাবেন একে। আমরা প্রথম দেখতে পাই পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার আগেই। বাসের জানালা দিয়েই দেখা যাচ্ছিলো একে। আমাদের হৈ হুল্লড় দেখে বাস থামিয়ে দেন ড্রাইভার, আর চলতে থাকে একের পর এক ক্লিক। টুরের সবচেয়ে স্বরনিয় সময় ছিলো সেই মুহুর্তটিই।
পঞ্চগড়ের "শালবাহান" নামে এক গ্রাম থেকে পুরো কাঞ্চনজঙ্ঘা রেইঞ্জটা দেখা যায়। এখান থেকে মূল চারটা পীক দেখা যায় যা আট হাজার মিটারের উপরে। বাংলাবান্ধা আর তেতুলিয়া থেকে এরকম পুরোটা দেখা যায় না। গ্রামটা পঞ্চগড়ের পূর্বদিকে। বাংলাবান্ধা হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় ডানদিকে (মানে পূর্বদিকে) ভিতরগড় রোড। লোকাল লোকজনদের জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেবে।
স্থানীয়রা জানালে আসেপাশের জেলাগুলো থেকেও অনেকে এ দৃশ্য দেখেছেন। গেলেই দেখা মিলবে বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। কারন হালকা মেঘ বা কুয়াসা থাকলেই আর দেখা দেবেনা এ লজ্জাবতী। কিছুটা ভাগ্যের ব্যাপার স্যাপার আছে। তবে শরত কাল এই দৃশ্য দেখার জন্য বেস্ট সময়। অর্থাৎ অক্টোবর এর ১৫ থেকে মোটামুটি নভেম্বর এর ১৫ তারিখ পর্যন্ত দেখা যায়। শরতের শেষের দিক হতে শীত পর্যন্ত তেতুলিয়া ডাক বাংলোতে দাঁড়িয়ে উত্তরের মেঘমুক্ত আকাশে তাকালেই চোখে পড়ে কাঞ্চনজঙ্ঘার মন হরণীয় মায়াবী দৃশ্য।
পঞ্চগড় থেকে সারা বছর কেন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়না?
দিনের বেলায় মাঝে মাঝে কখনো আকাশে চাঁদ দেখেছেন কি? আসলে সম্পুর্ণটাই হলো আলোর খেলা। শীতের সময় সূর্য্ দক্ষিণ দিকে ঝুকে থাকার কারণেই কাঞ্চনজঙ্ঘা এই রকম দৃশ্যমান হয়ে উঠে।
বাংলাদেশের একমাত্র পঞ্চগড় থেকে এভাবে দেখতে পাবেন হিমালয়ের তৃতীয় উচ্চ পর্বত শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘা । শরতের মাঝামাঝি জেলার যেকোন ফাকা মাঠে দাড়িয়ে দেখতে পাবেন হিমালয় এমনকি শহরের বিল্ডিং এর ফাকেও দেখা যায় হিমালয় । হিমালয় কন্যা বলে কথা । হিমালয় দেখার সবচেয়ে ভালো সময় অক্টোবর -নভেম্বর এর মাঝামাঝি । এ সময় সুর্য আনুভূমিক ভাবে দক্ষিনে বেশি হেলে পরে যা বছরের অন্য সময় হয় না ফলে সূর্যের আলো হিমালয়ের চুড়ায় প্রতিফলিত হয় ফলে দেখা যায় হিমালয় । আর বছরের অন্য সময়ে দেখা যায় না । তাই হিমালয় দর্শন করতে হলে আপনাকে আসতে হবে যথা সময়ে । যদিও তা অনেকটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করে ।
আর যা যা দেখবেন:
- পঞ্চগড়ের ভিতরগড় প্রত্নতাত্তিক সাইট এখানে দেখার মত একটি স্পট।
- আর তেতুলিয়া বাজারে সেই বিক্ষাত তেতুল গাছ না দেখলে কি হয় বলুন।
- মহারাজার দীঘি
- বদেশ্বরী মহাপীঠ মন্দির
- সমতলভূমিতে সম্প্রতি প্রতিষ্ঠিত চা-বাগান
- মির্জাপুর শাহী মসজিদ
- বার আউলিয়ার মাজার
- গোলকধাম মন্দির
- তেঁতুলিয়া ডাকবাংলো
- তেঁতুলিয়া পিকনিক কর্নার
- বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট ও বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর
- রকস্ মিউজিয়াম
এত সব কিছুর ভিড়ে পঞ্চগড়ের সেরা আরেকটি আকর্ষণ হল একটি পাখি । মহাবিপন্ন শেখ ফরিদ !! বাংলাদেশের হাতে গোনা কয়েকটি শেখ ফরিদ বাস করে শুধু মাত্র তেতুলিয়ায় । বাংলাদেশে আর কোথাও দেখা যাবেনা শেখ ফরিদ । শুধু বাংলাদেশেই নয় পৃথিবী জুড়েই বিপন্ন এই পাখি । তেতুলিয়ার কাজীপারা মে-জুলাই তাদের প্রজনন মৌসুমে দেখা যায় শেখফরিদ । যদিও দেখা এত সহজ নয় । আমি ৫ দিন সেখানে অপেক্ষা করে দেখছিলাম ২ বার ছবি তুলতে পেরেছি একবার ।
শেখ ফরিদ পাখি |
পঞ্চগড় নেমে একেবারে একটি অটো রিজার্ভ নিয়ে নিলে তেতুলিয়া সহ সব স্পট ঘুরিয়ে দেখাবে আপনাকে।
স্পেশাল খাবার:
তেতুলিয়া বাজারের তেতুল গাছের গোড়ায় বানানো চা ও মিস্টি, একবার খেলে মুখে লেগে থাকতে বাধ্য। তেঁতুলিয়ায় খাবার খুব চমৎকার। বাংলা হোটেলের হাফডজন ভর্তা খেয়ে আমি মুগ্ধ। গরুর দুধের চা তো আছেই।
যেখানে থাকবেনঃ
খাবার আর পরিবহন খুব সস্তাও বটে, ট্র্যাভেলারদের জন্য আদর্শ কন্ডিশন। ডাকবাংলোতে রুম পাওয়া কঠিন, পেলে ৫০০-৭০০ টাকায় এসিরুম আছে। পাশেই পিকনিক কর্ণারে মাত্র দু'শো টাকায় ডাবলবেডের রুম আছে, মন্দের ভাল! আর তেঁতুলিয়ায় হোটেল তো আছেই। আমার মনে হয় পঞ্চগড় শহরে না থেকে তেঁতুলিয়ায় থাকাই ভাল। কারন সেখান থেকে বাংলাবান্ধা জিরোপয়েন্ট মাত্র ১৭ কিমি দূরে, বাসভাড়া ২০ টাকা।
========================================================================
মন্তব্য অথবা কোন প্রশ্ন থাকলে নিচে কমেন্ট করুন।
ছবিটা কার তোলা আড় এইটা শেখ ফরিদ না
ReplyDeleteছবিটা ইন্টারনেট থেকে নেওয়া... ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য...
Delete